ইসলাম এবং রাজনীতিঃ সংকট এবং সম্ভাবনা 2
- AbuSayed Mahfuz
- Aug 16
- 5 min read
ইসলাম এবং রাজনীতিঃ সংকট এবং সম্ভাবনা
আবু সাইদ মাহফুজ
ইসলামি রাজনীতির আজকের পর্ব আলোচনা করতে গিয়ে একটি প্রশ্ন দিয়েই শুরু করতে চাই, সেটা হলো “ইসলামী রাজনীতি” বলতে আসলে আমি কি বুঝি? আপনি কি বুঝেন?
আমি মনে করি এই প্রশ্নটি অনেক মুসলমানকে বা সকল মুসলমানকে করা উচিৎ। যারা ইসলামী রাজনীতি পছন্দ করেন তাদেরকে ও করা উচিৎ কিংবা যারা ইসলামী রাজনীতিকে অপছন্দ করেন, কিংবা ভয় করেন বা ঘৃণা ও করেন তাদেরকে এই প্রশ্নটি করা উচিৎ।
আমি অনেকাংশে নিশ্চিত এই প্রশ্ন যদি করা হয় তাহলে উত্তর আসবে বিভিন্ন এবং বিচিত্র! উত্তরে হয়তোবা নিচের পরিভাষাগুলো আসবে বিভিন্নভাবে। কেউ বলবেন শরীয়া আইন এবং শরীয়া আইন শব্দ দুটো শোনার সাথে সাথে আপনার মাথায় কি আসবে?
আমার ধারণা, ইসলামী রাজনীতি বা শরীয়া আইন শব্দটা শোনার সাথে সাথে আপনার ‘আইসিস’ এর কথা মনে পড়েছে। মনে পড়তে পারে "চোরের সাজা হাত কাটা"। "জেনার সাজা পাথর মেরে মৃত্যুদন্ড।" কিংবা সৌদি আরবের কল্লা কাটার ছবি, তালেবানের চিত্র। ইসলামী রাজনীতি তারপর শরীয়া আইন কথাটা শোনার পর কারো কারো চোখে চিত্রটা ভেসে উঠবে আইসিসের সেই সাংবাদিক হত্যার ভিডিও ক্লিপ।
উপরের যে উদাহরণতুলো টানলাম সেগুলো ঠিক না বেঠিক কিংবা কতটুকু সঠিক বা কতটুকু বেঠিক সে সম্পর্কে আজকের আলোচনায় যাবনা। আজকের আলোচনায় শুধু এটাই উল্লেখ করতে চাই ইসলামী রাজনীতি নাম শুনলেই এমন দৃষ্টিভঙ্গি প্রথমই আসাটা ইসলাম এবং মুসলমানদের উপর অবিচার এবং দুঃখজনকভাবে এ জন্য দায়ী এক শ্রেণীর মুসলমানরাই।
ইসলামী রাজনীতি কিংবা শরীয়া আইন বলতে আমি যদি বলি, শরীয়া আইন বলতে আমি বুঝি নিরিহ অসহায় মানুষের অন্ন বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা নিশ্চিত করা। ইসলামী রাজনীতি বলতে প্রথমেই আমার মাথায় আসে, রাসুল সাঃ এর সে হাদীস, "কোন ব্যাক্তি জান্নাতে যেতে পারবে না, যতক্ষণ না, মুমিন হবে, পরষ্পরকে ভালবাসবে।"
আমি যদি বলি, ইসলামী রাজনীতি বলতে আমার মাথায় আসে রাসূল (সাঃ) সে হাদীস "যে ব্যাক্তি নিজে পেট পুরে খায়, অথচ তার প্রতিবেশী উপোষ করে, সে মুমিন হতে পারবে না।"
ইসলামি রাজনীতি বলতে আমি বুঝি, আল্লাহ পাক বলেছেন,
"হে মুমিনগন! যদি কোন ফাসিক তোমাদের কাছে কোন বার্তা নিয়ে আসে তোমরা তা পরীক্ষা করে দেখবে যাতে অজ্ঞতা বশত তোমরা কো সম্প্রদায়কে কষ্ট না পেীঁছাও, যাতে পরে তোমাদের কৃতকর্মের জন্য লজ্জিত হয়ে যাও"
ইসলামী রাজনীতি বলতে আমি বুঝি, আল্লাহ বলেছেন, কেউ যেন অপরকে বিদ্রুপ না করে, একে অপরকে দোষারোপ না করে, একে অপরকে মন্দ নামে না ডাকে। কোরআনে আমি যখন পড়ি, হে মুনিমগন তোমরা বেশী বেশী ধারণা এবং অনুমান করা থেকে বিরত থাকো, কারণ কোন কোন ধারণা এবং অনুমান পাপ, তোমরা একে অপরের গোপনীয় বিষয় অনুসন্ধান করো না, অপরের পশ্চাতে নিন্দা করোনা। “
আসলে কথাটা কিন্তু শুধু আমার নয়, ইতিপূর্বে ইসলামী রাজনীতিঃ সংকট এবং সম্ভাবনা ১; পর্ব ১ তেও ইমাম শাতেবির "মাক্কাসিদ আল শরীয়া" গ্রন্থের রেফারেন্স দিয়েছিলাম। ইমাম শাতেবী নামে একজন বিখ্যাত ইসলামী চিন্তাবিদ ছিলেন তাঁর সেই কিতাবের নাম "আল মুয়াফাক্কাত", সে কিতাবের একটা বড় অধ্যায় লিখেছেন যার নাম দিয়েছেন "মাক্কাসিদ আল শরীয়া"। অর্থাৎ শরীয়া আইনের মকসুদ বা উদ্দেশ্য কি? মাক্কাসিদ আশ শারে' বা আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা যেহেতু এই শরীয়া আইন আমাদের জন্য পাঠিয়েছেন আল্লাহ পাকের উদ্দেশ্যইটাই বা কি? সেই বিখ্যাত বিশাল গ্রন্থে ইমাম শাতেবী অনেক ব্যাপক আলোচনার কিছু বিষয়ের মধ্যে ইমাম শাতেবী একটা উল্ল্যেখযোগ্য আলোচনা করেছেন শরীয়া আইনের উদ্দেশ্য হচ্ছে মানুষের সমস্যার সমাধান করা, প্রয়োজন পুরণ করা। সেখানে তিনি আলোচনা করেছেন মানুষের প্রয়োজনটাই বা কি। মানুষের প্রয়োজন আলোচনা করতে গিয়ে তিনি তিন ধরনের প্রয়োজনের কথা বলেছেন তাঁর ভাষায় (১) জরুরীয়াত বা অবশ্যম্ভাবী প্রয়োজনীয় (২) হাজ্জীয়াত (প্রয়োজন তবে না হলেও চলে) (৩) তাহসিনিয়াত সেীন্দর্যবর্ধণ বা বিলাসীতা
জরুরীয়াত বা অবশ্যম্ভাবী প্রয়োজনগুলোর মধ্যে তিনি ৫টি মেীলিক চাহিদার কথা উল্লেখ করেছেন, যার মধ্যে রয়েছে তা হলো
(১)জীবনের নিরাপত্তা ( حفظ النفس ),
(২) সম্পদের নিরাপত্তা বা ( حفظ المال),
(৩) ধর্ম এবং বিশ্বাসের নিরাপত্তা (حفظ الدين)
(৪) মুক্তবুদ্ধি বা মুক্তচিন্তার নিরাপত্তা (حفظ العقل)
(৫) পরিবারের নিরাপত্তা (حفظ النسل)
ইমাম শাতেবীর এই ৫টি মেীলিক চাহিদাকে প্রায় সকল ইমামরাই সমর্থন করেছেন। এই ৫টি চাহিদা পুরণ করা যে শরীয়া আইনের প্রধাণ লক্ষ্য এ ব্যাপারে কোন ইমামই দ্বিমত করেন নি। তবে এই ৫ টি প্রয়োজনের ক্রমধারা নিয়ে ইমামদের মধ্যে মত পার্থক্য রয়েছে।
ইমাম বায়জাবী রঃ মানুষের জীবনের নিরাপত্তাকে ১ নং প্রয়োজন হিসেবে উল্লেখ করেছেন। তেমনিভাবে ইমাম ইবনে তাইমিয়াহ, ইমাম রাজী, ইমাম যারকাশী, ইমাম ক্বারাফী জীবনের নিরাপত্তাকে ১ নং বা প্রথম প্রয়োজন হিসেবে গুরুত্ব দিয়েছেন। ইমাম গাজালীর দুটি অভিমত পাওয়া যায়, এক অভিমতে তিনি জীবনের নিরাপত্তাকে ১ নং অপর অভিমতে তিনি বিশ্বাসের নিরাপত্তা বা হিফজুদ্দীনকে (حفظ الدين) ১নং হিসেবে উল্লেখ করেছেন। ইমাম সুবকী ও বিশ্বাসের নিরাপত্তাকে ১নং হিসেবে স্থান দিয়েছেন। উপরোক্ত ৫ টি মেীলিক চাহিদা পুরনের বাইরে ইমাম গাজালী ইসলামী শরীয়ার প্রধান উৎসের মধ্যে আরেকটি প্রধান পরিভাষা ব্যাবহার করেছেন সেটা হলো "মাসলাহা আল মুরসালাহ" (المصلح المرسله) বা জনকল্যাণ। ইমাম গাজালীর মতে জনকল্যাণমুলক নয় এমন কিছু ইসলামী শরীয়ার অংশ হতেই পারে না। ইমাম গাজালী রঃ এব্যাপারে আরো বিস্তারিত আলোচনার প্রেক্ষাপটে ইলম বা জ্ঞানার্জনকে দু ভাগে ভাগ করেছেন।
(১)কল্যানকর জ্ঞান
(২) অকল্যাণকর জ্ঞান
কল্যাণকর জ্ঞান হিসেবে ইমাম গাজালী বলেছেন যে জ্ঞান একজন মানুষকে সৃষ্টিকর্তাকে চেনায়, আত্নার উন্নয়ন করে, বা মানব কল্যানের জন্য ব্যবহৃত হয়, বা কমপক্ষে মানুষের কোণ ক্ষতি করে না সেটাই কল্যাণকর জ্ঞান। আর যে জ্ঞান মানুষকে সৃষ্টিকর্তৃাবিমুখ করে দেয়, বা যে জ্ঞান মানুষের ক্ষতি করার জন্য ব্যবহৃত হয় সে জ্ঞান অল্যাণকর জ্ঞান। ইমাম গাজালীর ব্যাবহৃত এই মাসলাহা আল মুরসালাহ অনেক ইমাম এবং ফক্কীহগন আলোচনা করেছেন এবং সমর্থন করেছেন। এসব ইমাম এবং ফকিহগন সিয়াসত (سياست) শব্দটা ব্যবহার করেছেন বলে চোখে পড়েনা। প্রায় সবাই শরিয়া (شريعه) শব্দটা ব্যাবহার করেছেন।
ইমাম আবু হানীফা একই অর্থে আরেকটি নতুন পরিভাষা ব্যবহার করেছেন সেটা হলো "ইসতিহসান"الاستحسان) ) কল্যান কামনা করা। অন্য অর্থে ইমাম আবু হানিফার দৃষ্টিতে ইসলামী শরীয়াতের কোন আইনই প্রণীত হতে পারে না যদি না সে আইনের মধ্যে মানুষের কল্যান কামনা করা না হয়। ইমাম শাফেয়ী আবার ইমাম আবু হানীফা রঃ এর ব্যাবহৃত এই পরিভাষা "ইসতিহসান" এর বিরোধীতা করেছেন। তিনি আরেকটি নতুন পরিভাষা ব্যবহার করেছেন সেটা হলো "ইসতিসলাহ" (الاستصلاح) বা যার বাংলা অনুবাদ হতে পারে সমস্যা সমাধান করা। ইমাম শাফেয়ী রঃ তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ আর রিসালাহ (الرساله) তে ইসতিসলাহ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন।
বলার অপেক্ষা রাখে না, উপরে উল্লেখিত ইমাম শাতেবীর (রঃ) মাক্কাসিদ আশ শারিয়া (مقاصد الشريعه) বা ইমাম গাজালীর রঃ ব্যাবহৃত পরিভাষা মাসলাহা আল মুরসালাহ ((المصلح المرسله) বা ইমাম আবু হানিফা রঃ ব্যাবহৃত ইসতিহসান (الاستحسان) কিংবা ইমাম শাফেয়ীর ইসতিসলাহ ( الاستصلاح) প্রতিটি পরিভাষাই এক একটি থিসিস আলোচনা দাবী রাখে, এবং এ ব্যপারে তাঁদের প্রত্যেকেরই নিজ নিজ ব্যবহৃত পরিভাষা বিশাল আকারে কিতাবাদি রয়েছে এবং অন্যন্য ইমাম বা ইসলামিক পন্ডিতদের যারা তাঁদের পরিভাষাকে সমর্থন করেছেন বা অসমর্থন করেছেন তাদের বিস্তারিত আলোচনা সমালোচনা রয়েছে। উদাহরণস্বরুপ বলা যায় ইমাম শাফেয়ী রঃ শুধুমাত্র ইসতিসলাহ নামে নিজের ফরমুলা দিয়েই ক্ষান্ত হন নাই তিনি ইমাম আবু হানিফা রঃ প্রদত্ত ফরমুলা ইসতিহসানের কড়া সমালোচনা করেছেন তাঁর বিখ্যাত আর রিসালাহ গ্রন্থে।
অপরদিকে শাহ ওয়ালী উল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলভী তিনি যদিও হানাফী মাজহাবের অনুসারী একজন বড় পন্ডিত ছিলেন, তিনি তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগাহ গ্রন্থে আরেকটি পরিভাষার উপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন সেটা হলো " 'ইল্লাহ" (عله) বা যুক্তি বু্দ্ধি। যেটাকে তিনি মূলত যুগ সমস্যার সমাধানের জন্য মুক্ত বুদ্ধি ব্যাবহারের পক্ষে কথা বলেছেন। কোরানের ভাষায় যেটা উলিল আবসার (اولي الابصار) উলিল আলবাব (اولي الالباب) আকিলুন (عاقلون )। আলোচনা সংশ্লিষ্ট বিষয়ে সীমাবদ্ধ রাখার স্বার্থে আমরা সেদিকে আলোচনায় যাচ্ছিনা। তবে শাহ ওয়ালি উল্লাহর রাজনৈতিক চিন্তাধারা এ ব্যপারে অনেক গবেষণা রয়েছে।
ইসলাম সর্ম্পকে খুব সাধারণ জ্ঞান যারা রাখেন সবাই জানেন, ইসলামী আইন বা শরীয়ার উৎস মুলত ৪টি (১)কোরআন (২) সুন্নাহ বা হাদীস (৩) ইজমা (৪) ক্কিয়াস
উপরে যে পরিভাষাগুলো ব্যাবহার করেছি, অর্থাৎ ইমাম গাজালীর ব্যবহৃত মাসলাহা আল মুরসালাহ, ইমাম আবু হানিফার পরিভাষা ইসতিহসান, ইমাম শাফেয়ীর ইসতিসলাহ এর সবগুলোই ক্কিয়াসের সাথে সম্পৃক্ত। অতি সম্প্রতি ডঃ আহমদ আল রাইসুনি নামক একজন পন্ডিত ২০১৪ সালে প্রকাশিত "আল তাজদীদ আল উসুলী" (الجديد الاصولي ) নামক একটি গ্রন্থে 'মাসলাহা আল মুরসালাহ' (مصلح المرسله) ক্বিয়াসের পরে বা ৫ম উৎস হিসেবে ব্যাবহার করেছেন।
উসুলে ফিকাহতে বিভিন্ন ইমামরা আরো কিছু পরিভাষা ব্যাবহার করেছেন যেগুেলো উপরোক্ত ব্যবহৃত পরিভাষাগুলোর সাথে সম্পৃক্ত। যেমন ইজতিহাদ, আক্কল, ইল্লাহ, ফিতরাহ, ও হ্যাঁ, ইমাম ইবনে তাইমিয়া এই ফিতরাহ পরিভাষা ব্যবহার করেছেন। ফিতরাহ শব্দের অর্থ হলো মানুষের সহজাত প্রকৃতি। এ ছাড়া ও আরো একটি পরিভাষা ব্যবহৃত হয়েছে ইসলামী সমাজ ব্যাবস্থার ক্ষেত্রে সেটা হলো তাজরাবাহ (التجربه) অভিজ্ঞতা বা পর্যবেক্ষণ।
ইসলামী সমাজ দর্শনের ক্ষেত্রে গভীর পর্যবেক্ষণ এবং অভিজ্ঞতার প্রয়োজন। আরেকটি উল্লেখযোগ্য পরিভাষা যদিও বিচ্ছিন্নভাবে ব্যবহৃত হয়েছে সেটা হলো "ওরফ" বা ঐতিহ্য, ট্র্যাডিশন। আমরা জানি ব্রিটেনে কাস্টম বা ট্রেডিশন হলো আইনের একটা প্রধান উৎস। মনে করুন। যে কোন একটা বিষয় যদি এখন প্রচলিত না থাকলেও কেউ যদি প্রমাণ করতে পারে যে এটা ব্রিটেনে একসময় সামাজিক রীতি বা কাস্টম হিসেবে প্রচলিত ছিল তাহলে সেটাও আইনে পরিণত হতে পারে। তেমনিভাবে ইসলামী সমাজ দর্শনে ব্যবহৃত হয়েছে "ওরফ" পরিভাষা। এই ওরফ সবেচে বেশী প্রসিদ্ধি লাভ করেছে বা এমনকি অনেক ক্ষেত্রে সফলকাম হয়েছে আধুনিক তুর্কিস্তানে। টার্কি বা তুর্কিস্তানের বর্তমান অবস্থার পেছনে ছিল গুলেন আন্দোলন বা ফাতহুল্লাহ গুলেনের ভুমিকার পাশাপাশি এই ওরফ এবং ঐতিহ্য একটা বিরাট ভুমিকা রাখে।
(চলবে ইনশাআল্লাহ)




Comments