সাদা হাতির দেশে
- AbuSayed Mahfuz
- Aug 17
- 24 min read
সাদা হাতির দেশ নাম হলেও আমরা সাদা হাতি দেখিনি। আদৌ সাদা হাতি আছে কি-না কে জানে। কোনোকালে হয়তো বা সাদা হাতি ছিল। কে নাম দিয়েছে তাও জানি না। ছোটকালে আরব্য উপন্যাসে সিন্দাবাদের দুঃসাহসিক সপ্তযাত্রার সাথে সাদা হাতির দেশ এবং শ্যাম রাজার দেশ হিসেবে শুনেছিলাম থাইল্যান্ডের কথা। আমার বন্ধুটিকে জিজ্ঞেস করেছিলাম এই সাদা হাতি সম্পর্কে। সে বললো, কোনোকালে হয়তো বা ছিল তবে আজ কোথাও আছে বলে সে জানে না। থাইল্যান্ড দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার একটি দেশ। এ দেশটি পশ্চিমা কোন সাম্রাজ্যবাদী দেশের অধীনে কখনো ছিলো না। দেশটির আয়তন ৫,১৪,০০০ বর্গ কিঃ মিঃ অর্থাৎ আমাদের বাংলাদেশের প্রায় ৩/৪ গুন বড়। জনসংখ্যা আমাদের অর্ধেকেরও কম। লোকসংখ্যা ৫ কোটি ৬৪ লক্ষ ৫৪ হাজার। ১৯৩৯ সালের পূর্বে দেশটির নাম ছিল ‘শ্যাম দেশ’।
১৭৮২ সাল থেকে ১৯৩৯ সাল পর্যন্ত এই শ্যাম দেশ নাম থাকার পর দেশটির নাম রাখা থাইল্যান্ড। ১৯৫৪ সালে আবার দেশটির নাম শ্যামদেশ পুনঃ প্রবর্তন করা হয়। কিন্তু মাত্র ৪ বছরে আবার তারা থাইল্যান্ড নামেই ফিরে আসে। দেশটিতে ৭৩টি প্রদেশ, ৬৯৯টি জেলা আছে। প্রতি প্রদেশে আলাদা গভর্ণর। থাইল্যান্ডে মোট ৬২,২০০ গ্রাম। থাইরা মূলত চীন, কম্বোডিয়া এবং মালয়েশিয়া থেকে আগত মিশ্র জাতি । এদেশের শতকরা ৮৭ জন লোক শিক্ষিত তবে ইংরেজী জানা লোকের সংখ্যা খুবই কম। থাইলান্ডে ২৩টি বিশ্ববিদ্যালয় আছে।
অনেক দিন থেকে ইচ্ছা জাগছিল থাইল্যান্ড ভ্রমণের। কিন্তু সময় করে পারছিলাম না। বিশেষত ইসলামী মূল্যবোধ ও সংস্কৃতির চরম ব্যতিক্রম এই দেশের মুসলমানরা কেমন আছে। কিভাবে চলে তাদের জীবনযাত্রা এসেব দেখতে খুব ইচ্ছা। এপ্রিলের শেষাংশে এবং মে’র প্রথম দিকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ছুটি পেলাম ক’দিনের। ভাবলাম এইতো সুযোগ জীবনে এ সুযোগ নাও আসতে পারে। তাছাড়া মালয়েশিয়া থেকে বাসে খুব কম খরচে চলে যাওয়া যাবে। যা ভাবা তাই কাজ। থাইল্যান্ড এবং ব্যাংকক। নামটা শুনলেই একটা ব্যতিক্রমই অনুভূতি আসে। অনুভুতিটা ব্যক্তিভেদে ব্যতিক্রম হয়। রুচিবানরা চমকে উঠেন। ব্যাংকক বিশ্বের মধ্যে মোটামোটি পরিচিত একটি শহর। একবার এই বছর খানেক আগে বিশ্ববিখ্যাত ইংরেজী অভিধান গ্রুপ লংম্যান কোম্পানি তাদের কোন এক অভিধানে ব্যাংকক সম্পর্কে সংজ্ঞা দিয়েছিল বিশ্বের মধ্যে পতিতালয়ের জন্য বিখ্যাত বলে। এতে ব্যাংককের রুচিবানরা ক্ষেপে যান। প্রতিবাদ জানান, তখন লংম্যান কর্তপক্ষ জবাব দেয় যে, কে কি চায় সেটা আমাদের লেখার বিষয় নয়, আমাদের লেখার বিষয় বাস্তবে আসলে কি আছে। সে বিতর্কে না গিয়েও বলা যায় ব্যাংককের পতিতালয়ের খ্যাতি বিশ্ব জোড়া। হ্যাঁ, ব্যাংকক যাবার চিন্তা করার পর থেকে আমিও চমকে উঠেছিলাম বার বার। আমাদের জীবনের পরিধি অনেক সংকীর্ণ। এই সংকীর্ণ পরিসরে আমার ব্যাংকক ভ্রমণটা ছিল এক দুঃসাহসিক অভিযাত্রা। কোথাও ভ্রমণে বের হবার পূর্বে সবসময় ২ রাকায়াত নফল নামাজ পড়ে বের হবার মত পরহেজগার আমি কখনো দাবী করতে পারবো না। তবে ব্যাংকক যাত্রার পূর্বে আমি দু’রাকাত নামায পড়েছিলাম। বললাম, আল্লাহ তুমি আমাকে হেফাজত কর। চরিত্রগত দিক ছাড়া ব্যাংককের নিরাপত্তার দিকটা শুনেছিলাম অনিশ্চিত। শহরের ও রাস্তায় প্রচুর নিশাচর থাকে। যারা সর্বস্ব কেড়ে নিতে পারে। পুরো থাইল্যান্ডে ইংরেজী জানা লোকের সংখ্যা একেবারেই হাতে গনা। এই অনেকগুলো প্রতিকূলতা নিয়েই আমার ব্যাংকক অভিযাত্রা।
৩রা মে’ মঙ্গলবার। দিনের বেলায় গিয়ে, বাসের টিকেট নিয়ে আসলাম থাইল্যান্ড সীমান্ত পর্যন্ত। কুয়ালালামপুর থেকে ব্যাংকক বাসে এবং ট্রেনে দু’দিনের রাস্তা। রাত ১০টায় আমার বাস ছাড়বে। সাড়ে ৯ টায় গিয়ে হাজির হলাম। বাস ষ্টপেজ থেকেই সোলায়মান ভাই এবং রফিক স্যারকে ফোন করে আমার যাত্রার সংবাদ দিলাম। রাত ১০টায় প্রথম পদক্ষেপেই যাত্রার সূচনা ঘটে। বাসে উঠে দেখলাম, আমার যে সীট সেই একই সীটে ২টি টিকিট বিক্রি হয়ে গেছে ভুলে এবং অন্য যাত্রী এসে বসে আছেন। রাত ১০টার পর আর
কোন বাস নেই। ট্রেন ও নেই। কিন্তু কোন ক্রমেই দেরী করার সময়ও আমার নেই। কি সমস্যা? বাস মালিকদেরকে খুব বকাবকি করলাম। তারা বললো তোমার টাকা ফেরৎ দিবো। আমি মানলাম না শেষে প্রস্তাব করলো ড্রাইভারের পাশে একটা সীট আছে, সেটাতে বসে যেতে পারি কিনা। কিন্তু অন্য কোন সুযোগ-সুবিধা নেই। যেমন বাস ছিল সুপার ভি, আই, পিঁ অর্থাৎ একটা বাসে মাত্র ২৫/৩০ জন যাত্রী, অত্যন্ত প্রশস্ত সীট ছাড়াও রাতে ইয়ারকনের সীট নিবারণের জন্য রয়েছে হালকা কম্বল এবং বালিশ। দস্তুর মতো শুয়ে যাওয়া যায়। অথচ এই সীটে এইসব কিছুই নেই। কিন্তু যে কোন প্রকারে আমাকে আজই যেতে হবে। ভাবলাম আমরা দরিদ্রতম দেশের মানুষ। আমাদের এইসবে অভ্যাস আছে। ঢাকা থেকে নোয়াখালী সারারাত দাঁড়িয়ে ভ্রমণ করার ও অভিজ্ঞতা আছে। বাসের হ্যান্ডেল ধরে ঝুলে থাকার অভ্যাস ও আমাদের আছে। তাই রাজি হয়ে গেলাম। যদিও ৩০ ডলার ভাড়া দিয়ে বাসের সুযোগ-সুবিধা গুলো না পাওয়ার জন্য আফসোস হচ্ছিল। সারা রাত বেশ কষ্টই হলো, ভোর ৪টার দিকে আমরা সীমান্তের কাছা-কাছি পৌঁছলাম। একটা বাজারে বাস থামানো হলো। ইতোপূর্বে আমাকে আমার থাইল্যান্ডের অন্য এক বন্ধু বিস্তারিত বর্ণনা দিয়েছিল। সে বলেছিল, রাত ৪টার সময় সীমান্তের প্রায় কাছা-কাছি এক বাজারে এক হোটেলের সামনে থামবে। সেখানে টাকা পাল্টানোর ব্যবস্থা আছে। মাত্র ২০/২৫ মিনিটের মাথায় আমরা মালয়েশীয়ার সীমান্ত অতিক্রম করলাম, রি-এন্ট্রি ভিসা আছে কিনা তা দেখেই মালয়েশীয় ইমিগ্রেশন বের হওয়ার অনুমতি দিয়ে দিল। কিন্তু সমস্যা শুরু হলো থাই সীমান্তে। আমাকে বাসের ড্রাইভার আগেই বলে দিয়েছিল, থাই সীমান্ত বাংলাদেশী পাসপোর্ট ধারীকে আরো ৩০ ডলার দিতে হবে। আমি বারবার তর্ক করছিলাম যে, আমার বৈধ ভিসা আছে। কিন্তু না, কোনো ক্রমেই হলো না। তারা এটাও মানছিল না যে এটা ঘুষ, বললো এটাই নিয়ম। বাংলাদেশের এই সবুজ পাসপোর্টটি যেন সব দোষ করেছে। বাংলাদেশ নাম লেখা সবুজ এই পাসপোর্ট দেখলেই সকলে হাত বাড়ায়। অনেক কথা কাটাকটির পর আমাকেও ৩০ ডলার দিতে হলো। এটা নিঃস্বন্দেহে ঘুষ, মনে খুব কষ্ট পেলাম। যদিও আমার জীবনটা খুব বড় নয়। তবুও জীবনে এই প্রথম ঘুষ প্রদান করলাম। মনের মধ্যে এক অপারাধবোধ পীড়া দিচ্ছিল। কাজটা কি ঠিক করলাম? তাই বলে অন্যায় দেখলে বা করলে বিবেকের দংশন করার মত মন এখনো আছে, বুঝতে পারলাম। থাই সীমান্ত পেরিয়ে ১ঘন্টা বাস চলার পর আমরা আমদের আপাততঃ গন্তব্য হাত্যাই (উচ্চারণ হাজজাই) পৌঁছলাম আমার হাত ঘড়িতে তখন সকাল ৮টা। মনে ছিল না। যে এক দেশ থেকে অন্য দেশে পৌঁছেছি। তাই সময় পরিবর্তন হয়েছে। বাস থেকে নেমে একজনের সহযোগিতা চাইলাম জানতে চাইলাম কিভাবে আমি ব্যাংকক যেতে পারব। ভদ্রলোক হাতের ইশারা রেলষ্টেশন দেখিয়ে দিলেন ভাঙ্গা ইংরেজীতে জানায় আমি মাত্র ১৬৯ বার্থ (থাই মুদ্রা) অর্থাৎ মাত্র ১৭ মালয়েশীয় রিংগিট দিয়ে ট্রেনে ব্যাংকক যেতে পারি। জিজ্ঞেস করে জানলাম রেল স্টেশনে আমি হেঁটে ও যেতে পারব । কাছেই, কিছু দূর গিয়ে কোনো দিকে যেতে হবে ভেবে না পেয়ে পুলিশকে জিঙ্গেস করলাম । কিন্তু এই প্রথম মুখোমুখি হলাম এমন ব্যক্তির যিনি ইংরেজী জানেন না । কোন বাক্যে বা ক্রিয়াপদ ব্যবহার না করেই শুধুমাত্র রেলওয়ে স্টেশন শব্দটা উচ্চারণ করলাম, না বুঝলো না । আগে সোলায়মান ভাই বলে দিয়েছিলেন । যে থাই ভাষায় রেল স্টেশনকে বলা হয় ‘রোড পাই’, কিন্তু শব্দটা ‘রোড পাই’, নাকি ‘রোড বাই’, সে ব্যাপারে আমি নিশ্চিত ছিলাম না । তবু রোড পাই’, এবং ‘রোড বাই’ দুটোই বলে দেখলাম তবু বুঝল না । হয়তো বা আমার উচ্ছারণ যথাযথ ছিল না । আমি কি বললাম, পুলিশ কি বললো কেউ কাউকে বুঝলাম না । শুধু থ্যাঙ্ক ইউ বলে বিদায় হলাম ।
কিছু দুর গিয়ে পরিপাটি জামা কাপড় পরিহিত একজন খুজে বের করলাম, যে কি না ইংরেজী জানতে পারে বলে ধারণা করলাম, কিন্তু অবস্থা তথৈবচ, তবে আমার আনেক রকম শব্দ প্রয়োগে কোন একটা হয়তো বা তার বোধশক্তিকে পৌঁছেল। সে বললো ও ! ট্রেন, ট্রেন! আমি যেন গভীর অন্ধকারে আলোর দিশা পেলাম, বেশ জোরে জোরে ইয়েস ইয়েস করতে করতে মাথা উপর-নিচ করতে লাগলাম। কিছুক্ষণ হাঁটার পর রেল স্টেশন খুঁজে পেলাম এবং খুঁজে পেলাম ইনফরমেশন বুথ। ভাবলাম সেখানে নিশ্চয়ই ইংরেজী জানা লোক আছে। আমার ধারণা ভুল হয়নি সত্য, সেখানে ইংরেজী জানা লোক পেলাম বটে কিন্তু এমন ইংরেজী উচ্চারণ বোঝা কার বাপের সাধ্যি। তবুও এটাই অন্ধের যষ্ঠি।
ব্যাংককের ট্রেন বিকেল ৩টায়। ২য় শ্রেণীর টিকেট ফুরিয়ে গেছে। ১৬৯বার্থ দিয়ে ৩য় শ্রেণীর একটা টিকেট নিলাম। আর জেনে নিলাম আশেপাশে কোন মসজিদ আছে কি-না। হ্যাঁ স্টেশন থেকে অর্ধ মাইলের কাছাকাছি একটা মসজিদ আছে। বেরুলাম মসজিদের সন্ধানে। কিন্তু আবার সেই সমস্যা। কোন বাক্য প্রয়োগ ছাড়া শুধু মসজিদ শব্দ বললাম, নাহ বুঝলো না। শুনেছিলাম থাইরা মসজিদকে ’মাস ইদ’ বলে। সেটাও বলে দেখলাম, না ঠিকমত হচ্ছে না। শেষে বললাম মুসলিম, তাতে ও বুজলোনা । তারপর দু’হাত কান বরাবর তুলে তকবীর দেয়ার ভঙ্গি করলাম, এসবের কোথায়ও হয়তো কেউ কোন এক শব্দ বুঝলো, অবশেষে মসজিদ খুজে পেলাম। মসজিদের সীমানায় গিয়ে মসজিদ প্রাঙ্গণ দিয়ে মসজিদ ভবনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলাম, দেখলাম এক ভদ্রলোক আসছেন, পরনে আজনুলম্বিত জোব্বা, গাল ভর্তি দাঁড়ি এবং মাথায় পাগড়ী। ধরে নিলাম নিশ্চয়ই মসজিদের ইমাম হবেন। সালাম দিয়ে জানতে চাইলাম তিনি আরবী জানেন কি-না। ভদ্রলোক বললো, আরবী নয় তিনি ইংরেজী জানেন, খুশি হলাম স্বভাবতই। তিনি এমএ পাস। তাবলীগ করেন। আমি বাংলাদেশী, মালয়েশীয়ায় পড়ালেখা করি। এসব পরিচয় দিতে শুরু করলে ভদ্রলোক আমাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, ”ঐ যে ওখানে তোমার দেশী ক’জন আছে তাদের সাথে কথা বল, আমি ব্যস্ত।” লোকটির আচরণে আমি খুশি হতে পারলাম না। যাক, মসজিদের দিকে এগিয়ে গিয়ে ২/৩ জন যাদেরকে পেলাম, বুঝতে কষ্ট হলো না তারা যে বাংলাদেশী। এদের মধ্যে ছিল নরসিংদীর ভাবনিয়া, চুয়াডাঙ্গার আবদুল হালিম, কুমিল্লার কবির ইসলাম এবং পাবনার ইয়াছিন মোল্লা ও আবদুর রহমান। এরা এসেছে ঢাকার শান্তি নগর যমুনা এজেন্সীর মাধ্যমে। এজেন্সীর লোকজন তাদেরকে মালয়েশিয়া নেবে বলে এনে এখানে ফেলে রেখে চলে গেছে। এখন তারা এই মসজিদেই থাকেন। মসজিদ কমিটির কোন এক ব্যক্তি তাদেরকে দয়া করে ২/৪টা খেতে দেন আর মাঝে মধ্যে মসজিদের খেদমত করান।
আমি বাংলাদেশী এই অসহায় বন্ধুদের সাথে আলাপচারিতার সময়ই মনে পড়লো যে আমরা ঘড়ির সময় বদল করা দরকার। কিন্তু মালয়েশিয়া এবং থাইল্যান্ডের মধ্যে সময়ের পার্থক্য কত আমার জানা ছিল না । একটু এগিয়ে গিয়ে মসজিদের ঘড়ির সাথে মিলিয়ে দেখনাম, আমার ঘড়ি বরাবর ১ঘন্টা এগিয়ে আছে। তাই পিছিয়ে দিলাম সে সময়। মালয়েশিয়া এবং থাইল্যান্ড যদিও গ্রীনিচের পূর্ব দ্রাঘিমাংশ’র ১০০ রেখা বরাবর তথাপি এই ২ দেশের মধ্যে ১ঘন্টা সময়ের ব্যবধান। একটু বেমিল, এই আর কি। তাই কিছু বেমিল চোখে পড়ল। এখানে দুপুর সাড়ে ১২টায় জোহর নামাজের আজান দেয়া হয় এবং ১টার মধ্যে জামাত শেষ হয়ে যায়। আমি হাজ্জাইতে যে মসজিদে নামাজ পড়ালাম এবং যাত্রাবিরতি করলাম, সে মসজিদটির নাম ‘মসজিদ পাকিস্তান’ । এ মসজিদ এলাকায় প্রচুর পরিমাণে পাকিস্তানী রয়েছেন। পাকিস্তান থেকে আগত মুসলমানরী এই মসজিদটি প্রতিষ্টা করেন । আমি মসজিদ কমিটির কয়েক জনের সাথে উর্দুত কথা বলেছি। শুধু এই হাজ্জাই এলাকায়ই নয়, থাইল্যান্ডের মুসলমানদের নাম করতে গেলেই পাকিস্তানী মুসলমানদের কথা এসে যায়। ব্যাংককেও পাকিস্তানীদের নিজস্ব এলাকা রয়েছে, মসজিদ রয়েছ। যে মসজিদটির নাম হারুন মসজিদা।
বিকেল ৩টায় ব্যাংকক যাবার পথে ট্রেনে চড়ার পূর্বেই আমি আমার একজন সঙ্গী পেয়ে গেলাম, যে সঙ্গিটি শুধু বাংলাদেশীই নন, তার বাড়ী আমার বাড়ী তেকে মাত্র ১০/১৫ মাইলের ব্যবধান। মজার ব্যাপার হলো, তিনি একজন পাতি আদম ব্যাপারী, তিনি একাধিকবার মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড এসেছেন এই আদম পাচারের কাজে।
স্বভাবতঃই কোন আদম বেপারীকে আমার ভাল না লাগলেও এই ভদ্রলোকের সাথে আমার এই লম্বা ট্রেনযাত্রা ভালভাবেই জমেছিল সম্ভবতঃ দুটি কারণে (১) এই দীর্ঘ ভ্রমণে আমি একজন সঙ্গী খুজছিলাম, ইনি ছিলেন আমার একমাত্র অন্ধের যষ্ঠি। (২) হয়তো ভদ্রলোক বেশ আমুদে এবং সদালাপী ।
বেলা ৩টায় আমরা ট্রেনে চড়লাম। প্রচন্ড গরম। এটা একটা ৩য় শ্রেণীর বগি। ট্রেনের হালহকিকত অনেকটা বাংলাদেশের ট্রেনের মতো, তবে একটু উন্নত পর্যায়ের। বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চল আন্তঃনগর ট্রেনের মতো। যেমন রাজশাহী থেকে, রাজবাড়ী ঘাট যে আন্তঃনগর ট্রেন পদ্মা অথবা ঢাকা নোয়াখালী উপকূল এক্সপ্রেসের শ্রেণী অনেকটা সে রকম। ফেরিওয়ালার নির্যাতন অবিকল সে রকম। তবে কোন ফকিরের জ্বালাতন নেই। সীট কেপাসিটি ট্রেন হলেও বেশ কিছু দাঁড়ানো যাত্রী ছিলো। তবে আমাদেরকে সবচে বেশি জ্বালাতন করেছিলো আমাদের পেছনের লাইনোর সিটগুলোতে বসা ক জন তরুণ। ট্রেনে আমাদের পেছনে বসা তরুণরা আমাদেরকে নির্যাতন করছিলো।
আমরা ট্রেনে চড়লাম ১০/১৫ মিনিটের মধ্যে স্বাভাবিকভাবে প্রকাশিত হয়ে পড়ে যে, আমরা বিদেশী, তাও বাংলাদেশী। আমাদের ট্রেনে বা অন্তত আমাদের বগিতে যারা উঠেছিল তাদের অনেকেই ছিল আচরণে ৩য় শ্রেণী। বিশ্বের অন্যান্য দেশের মত থাইল্যান্ডের মানুষরাও মনে করে যে, বিদেশী যুবক নিশ্চয়ই ব্যাংককে যাচ্ছি ফুর্তি করার জন্য। তাই তারা ইংরেজীর কোন একাটি শব্দ না জানলেও ভাঙ্গা ভাঙ্গা শব্দ এবং এই খোলা ট্রেনে অঙ্গভঙ্গির মাধ্যমে খুর খারাপ কিছুই আমাদেরকে বুঝাতে লাগলো। তাদের কথাবার্তার কিছু বোঝা না গেলে অঙ্গ ভঙ্গিতে যা আন্দাজ করলাম তা হলো তারা দালালের কাজ করতে রাজি এবং তাদের সন্ধানে ভাল শিকার আছে। তাদের এই নিশব্দ আহবানের স্পষ্ট বহিঃপ্রকাশ ঘটলো ঘন্টাখানেকের মধ্যেই। গাড়ীর ৩য় শ্রেণীর এই প্রকাশ্য বগিতে তারা মদের আসর বসালো। কথাটা অনেকের কাছে অবিশ্বাস্য মনে হতে পারে, হয়ত, কিন্তু এটাই ছিল বাস্তবতা। শুধু তাই নয়, তাদের সাথে যোগ দিল ত্রিশোর্দ্ধা এক মহিলাও। অত্যন্ত জোরে শব্দ করে মদের বোতল খুলছে, হাসি-ঠাট্রা, হৈল্লোড়, চিৎকার করছে। কিন্তু কিছুতেই আশপাশ যাত্রীদের কারো প্রতিবাদ তো দূরে থাক বিরক্তিও দেখলাম না । ছিল না সামান্য ভাবান্তরও। যেন এটাই স্বাভাবিক। এমনকি দেখলাম রেলওয়ে পুলিশও হেটে চলে যাচ্ছে নির্বাক।
এক দফা চালিয়ে যাবার পর কিছুটা তৃপ্তি কিন্তু ক্লান্তি নিয়ে ঘন্টাখানেকের জন্য চুপ থেকে আবার চললো আসর । ৩য় দফা সমাপ্তির পর দেখা গেল যেন ছিলাম আমরা দুই বিদেশী। বরাবর তাদের আসরে আমন্ত্রণ জানানো, ছাড়াও বেশ কয়েকবার মদ ভর্তি গ্লাস এগিয়ে দিচ্ছিল, সীটের উপর দিয়ে মাথার উপর ফেলছে ফেলছে এমন অবস্থা । মনে মনে প্রচন্ড বিরক্তি জমছিল পুরো থাইল্যান্ডের উপরই। তাদের অভদ্রতা, অশালীনতা এবং সীমাতিরিক্ততার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছিল ৩/৪ ঘণ্টা যাবত । অর্থাৎ দীর্ঘ ৩ দফা মদ ভোজনের পর এক-দুজন ট্রেনের মধ্যে মাতাল হতে শুরু করলো। কিন্তু এখনো ’পাগলের মাথা ঠিক ছিল, একজন এসে আক্রমণ করে বসলো আমার সঙ্গীটিকে। আমি জানালার পাশে ছিলাম বলে লাগ পেল না। মাতাল ছেলেটি এ অবস্থায় যা বলার বিচ্ছিন্নভাবে এটা-ওটা বলতে লাগলো, আমরা প্রথমে মনে করেছিলাম দিনের মত এখনো সে আমাদেরকে নারী ভোগের লোভ দেখাচ্ছে। কিন্তু তার শেষ আচরণে বুঝতে পারলাম আসলে সে মাতাল হয়ে পড়েছিল। দীর্ঘক্ষণ তার বিচ্ছিন্ন বকাবকির পর সে নিজের দিকে হাতে আঙ্গুলগুলো নির্দেশ করে বলিছিল পুলিশ, পুলিশ। তারপরই আবার বললো, বক্সিং, বক্সিং বলেই সে হাত গুটাতে লাগলো এবং আমার সঙ্গীটিকে বক্সিং দিয়েই দিচ্ছিল এতে আমার সঙ্গিটি এবং আমি দু,জনেই দাঁড়িয়ে গেলাম এবং চিৎকার দিয়ে বকাবকি শুরু করলাম। এতে মাতাল ছেলেটা কয়েক সেকেন্ডের জন্য হয়তো বা ভয় পেল এবং তার দু’একজন সঙ্গীও ছুটে এলো তাকে ২/১ টা থাপ্পর দিয়ে নিযে গেলো এবং একটা সীটে শুইয়ে দিল। তার পর তার এক সঙ্গী এসে আমার আক্রান্ত সঙ্গীটিকে ২ বার বললো সরি, সরি,। কিন্তু আশ্চর্যেও ব্যাপার হলো গাড়ীর অন্য কোন একজন যাত্রীও টু শব্দটি করলো না, প্রতিবাদ তো দূরে থাক। জানি না কেমন ভদ্র এ জাতি। মনটা বড়ই খারাপ হয়ে গেল এবং বলতে গেলে কিছুটা ভীত, কিছুটা বিক্ষুব্ধ হয়ে পড়লাম।
ট্রেনের মধ্যে অন্য একটি মজার বিষয় লক্ষ্য করছি। রাত ১১টার দিকে মাঝপথে কোন এক স্টেশন থেকে জনৈক যাত্রী উঠলেন। যার পরনে ছিল অত্যন্ত ছোট একটি হাফপ্যান্ট, গায়ে বুক ফাঁড়া স্লীভলেস (হাতাহীন) গেঞ্জি, পায়ের তলায় ছেঁড়া পুরনো কাপড়ের জুতা। লোকটির শরীর এবং চুলের রং বাদামী। চেহারা আদল বেশ সুগঠিত। ব্যায়াম করা পেটানো শরীর, শরীর কোনো বাড়তি মেদ নেই। পরনের ছোট হাফপ্যান্ট টিতে ডানদিকে একটা পকেট আছে। লোকটি মাঝে মধ্যে এ পকেটে হাত দিয়ে একটা ছোট থলে বের করে সেখানে থেকে টাকা বের করে এটা ওটা কিনে খাচ্ছে । আমার নিশ্চিত ধারণা হচ্ছিল লোকটা ইউরোপীয় বা আমেরিকান হবে। রাত ১২/১টার দিকে অর্থাৎ গাড়ীতে ওঠার ঘন্টা খানেকের মধ্যে লোকটা সম্পুর্ণ মেঝেতে নিঃশংকোচে বসে পড়লো এবং এই জন চলাচলের স্থানে শুয়ে পড়লো। সকাল বেলা আমি হাত মুখ ধুতে গেলাম ফিরে এসে দেখি লাল বদনের লোকটি আমার সীটেই বসে আছে আমাকে সীটের দিকে এগিয়ে আসতে দেখেই ভদ্রলোক ওঠে দাড়াতে উদ্যত হলেন। আমি ভাবলাম, আমি তো সারা রাতই বসলাম, বেচারা তো সারারাত ফ্লোরেই ছিল। আমি অনেকটা জোর করে তাকে বসিয়ে দিলাম। আর ভাবলাম, যাক লোকটার সাথে আেলাপ জমানোর একটা সুযোগ বোধ হয় হলো। লোকটার নাম আমি শুনেছিলাম কিন্তু ভুলে গেছি। বৃটিশ, অষ্ট্রের্লিয়ায় চাকরি করেন একাউটেন্ট হিসাবে। ছুটি কাটাতে এসেছে থাইল্যান্ড এবং মালয়েশিয়া। আমি বাংলাদেশী মালয়েশিয়াতে পড়াশুনা করছি, এগুলো শুনে একটি শব্দই সে বেশী ব্যবহার করছিল তাহলো ‘রিয়ালি’! এটা অনেকটা এমন প্রকাশ করছিল সে আমরা কারো কথা শুনে বলে থাকি ”ও আচ্ছা, তাই নাকি” তবে আমি মাষ্টার্স করছি এটা তাকে কিছুটা বিস্মিতও ভাব ও প্রকাশ করেছেন। বিদেশী অনেক দেশেইবিশেষ করে যে দেশগুলোতে চাকুরী সচরাচর পাওয়া যায়, সে সব দেশে মাষ্টার্স করছে শুনলে চমকে ওঠে। বাংলাদেশের মত বিদেশে এত অহরহ এম এ করেনা। লোকটা আরেকটু আশ্চার্য হলো বা ‘রিয়ালি’! বললো যখন জিজ্ঞেস করলো তুমি ইংরেজি শিখেছ কোথায়, আমি যখন বললাম বাংলাদেশেই।
সকাল সাড়ে ৮টার সময় আমি আমার গন্তব্যে পৌছালাম। আমি যে ষ্টেশনে নামলাম ষ্টেশনটির নাম সামসীন (SAMSEAN) ব্যাংকক থেকে ১/২ ষ্টেশন দক্ষিনে। আমার ব্যংককের বন্ধুটি থাই ভায়ায় ষ্টেশনটির নাম লিখে দিয়েছিলো বলে ২/১ জনকে দেখালে তারা আমাকে এ ষ্টেশনে নামতে সাহায্য করে। ষ্টেশন থেকে বেরুনোর সাথে সাথে ভাড়াটিয়া টেক্সিওয়ালারা ইংরেজী জানে না। টেক্সিতে উঠলে আমাকে কোনো হোটেলে নিয়ে যাবে এবং ফ্যাসাদে পড়তে হবে পুরো ।
আমার বন্ধুটির নাম নাসির। থাই নাম নিতিসাক। থ্যাইল্যান্ডের মুসলমানদের প্রায় প্রত্যেকেরই মুসলিম ছাড়াও থাই নাম থাকতে হয়। কোনো মুসলিম শিশু জন্ম নেয়ার পর সরকারী খাতায় নাম লেখাতে গেলেই থাই নাম দিতে হবে, নচেৎ নাম রেজিষ্ট্রি করবে না। থাই মুসলিমদের জন্য এটা একটা বিড়ম্বনা। কথাটা ঘুরিয়ে বললে অর্থাৎ থাই সরকার মুসলমানদেরকে মুসলিম নাম লিখতে দেয় না সরকারীভাবে থ্যাই নামই ব্যবহার করতে হবে। কিন্তু মুসলমানদের নিজেদের ঐতিহ্য এবং স্বকীয়তা রক্ষার জন্য মুসলিম নাম ব্যবহার করে থাকে ।আমি নাসির দেয় ঠিকানা এবং নির্দেশনা আনুযায়ী সামসীন (SAMSEAN) স্টেশনে নেমে নাসিরকে ফোন করলাম। ভাগ্য ভালো তাকে পেয়েও গেলাম। যদিও সে কিছুক্ষণের মধ্যেই বেরুচ্ছিল। আমার ফোন পেয়ে বলল, তুমি অপেক্ষা কর, আমি ২০/২৫ মিনিটের মধ্যে চলে আসছি । ২০/২৫ মিনিট গিয়ে আধাঘন্টা গেল, তারপরও ১ঘন্টা পেরিয়ে গেল। প্রায় দেড় ঘন্টা গেল কিন্তু নাসির এলো না। তাই আমি বাসায় আবার ফোন করলাম। বাসা থেকে বলা হলো সে বেশ কিছুক্ষণ আগে বেরিয়ে গেছে। কিছুটা দুশ্চিন্তায় পড়ে গেলাম, কিন্তু অপেক্ষা করা ছাড়া গত্যন্তর দেখলাম না। হঠাৎ স্মরণে এলো যে, আমার কাছে থাইল্যানেডর কয়েকটি মুসলিম সংস্থার টেলিফোন নম্বর আছে আমি ইয়াং মুসলিম এসোসিয়েশন অফ থাইল্যান্ড সংক্ষেপে (চুইক) এর প্রেসিডেন্ট ব্রাদার জালাল উদ্দিন কে ফোন জালাল সাহেবের থাই নাম সারাওত টেলিফোনে জালল সাহেবকেও পেয়ে গেলাম। তিনি ওই দিনই হজ্জে যাচ্ছেন।
কিছুক্ষন পর নাসির এলো ট্রাফিক জ্যাম এর কারণেই এত দেরি। প্রসঙ্গত ব্যাংককের ট্রাফিক জ্যামের সম্পর্কে কিছু বলা দরকার ব্যাংককে ট্রাফিক জ্যাম খুবই মারাত্মক। পুরানো ঢাকার সদরঘাট চকবাজার আর বাবু বাজার এলাকার জামের চেয়ে কোনো অংশ কম নয়। ব্যাংকক বা থাইল্যান্ডের সাথে অনেক দিক থেকেই বাংলাদেশের সাথে মিল। ব্যাংককের ঘনবসতি, ঘিঞ্জিগলি, অপরিকল্পিত শহরায়ান, চুরি প্রতারণা প্রায় সবই আছে বাংলাদেশের মতো। এমনকি ট্রেনে যেতে যেতে দেখলাম গ্রাম গ্রামান্তর বাংলাদেশ থেকে অভিন্ন। মানুয়গুলোর গায়ের রংও সমান তামাটে। শহুরেরা আপেক্ষিক বিচারে হলুদীয়। ট্রেনের বা রেললাইনের পাশে বাংলাদেশের মতই অবিকল বন বাদাড় ঝোপঝাড় এখানে সেখানে নারকেল সুপারি গাছ, আগাছা জঙ্গল বিষ কাটালি হরেক রকম হয়ত। হঠাৎ চোখে পড়লো একটি ছোট্র পুকুর, পুকুর পাড়ে ছোট বাড়ি, বাড়ি থেকে পুকুর ঘাটে কলসি কাখে এগিয়ে আসছে এক উচ্ছল তরুণী । তবে না তরুণীর পরনে কোন শাড়ি নেই, টার পরনে থাই পোশাক। কোথাও চোখে পড়ল বিশাল দিঘী, দিঘীর এক প্রান্তে স্কুল ঘর। ছোট খাল, নালা কালভার্ট সবই আছে।
সে যাক আমরা আবার ব্যাংককে ফিরে আসি। নাসির তাদের প্রাইভেট কার নিয়ে এসেছিল। তাদের দুটো গাড়ী আছে। ও আমাকে জানালো, ব্যাংককে এখন মালয়েশিয়া থেকে আগত আমাদের ইউনিভার্সিটির আরো দু জন ছাত্র আছে। একজন আফ্রিকা মহাদেশের মালায়ি নাসিলা, আমার পার্শ্ববতী রুমে থাকে। আমাদের অন্য বাংলাদেশী বন্ধু আবদুর রহমানের রুমমেট। অপর জনও আফ্রিকান তার নাম বাকালি; নাসির আমাকে প্রথমে নিয়ে গেল এক মুসলিম রেষ্টুরেন্টে। জিজ্ঞেস করলো কি খেতে চাই। আমি বললাম, হালাল যে কোন খাবার। তাছাড়া আমি তোমাদের খাবার দেখতে চাই। সে হোটেল বেয়ারা তরুণীকে কি বললো বুঝলাম না। কিছুক্ষণ পর পোলাও জাতীয় ভাত এবং ভিন্ন পদ্ধতিতে রান্না করা মুরগীর গোস্ত এলো, স্বাদের ভিন্নতা নিয়েই খেলাম এবং ভালই লাগলো। কিছুক্ষণ পর গরুর খুরা বা পায়ের হাড় দিয়ে তৈরী সুপ এলো। সুপ্যের মধ্যে কমপক্ষে এককুড়ি কাঁচা মরিচ দেওয়া হয়েছে। নাসির আমাকে বললো, আমি তাদেরকে কাচা মরিচ দিতে বারণ করতে ভুলে গিয়েছিলাম, এখন খেতে কি খুব অসুবিধা হবে। আমি বললাম, চিন্তা করো না, আমি যদিও কাচা মরিচে খুব অভ্যস্ত না তবু আমরা মরিচেরই দেশের লোক। আমাদের দেশে এমন লোক অনেক আছেও যারা পুরো মরিচ চিবিয়ে খায়। বেশ বেশ ঝাল লাগলেও স্যুপটা বেশ স্বাদই লাগলো।
আমি যে হোটেলে উঠলাম হোটেলটির নাম “দিল্লী দরবার” একটি মুসলিম হোটেল। মালিক পাকিস্তানী মুসলিম। আগেই বলেছি, থাইল্যান্ডে একটা বিষয় লক্ষ করছি সেটা হলো এখানে পাকিস্তানী মুসলমানেরা উল্লেখযোগ্য হারে প্রভাব বিস্তার করে আছে। মালিক কর্মচারী অনেকেই উর্দু ভাষার কথা বলেন। থাই ভাষাও জানেন। কাউন্টারে মহিলা ছিল থাই। আর হোটেলটি মুসলিম হিসেবে কিছু বৈশিষ্ঠ্য বজায় রাখলেও ব্যাংককের প্রভাবও পড়েছে। আমার দুদিনের ভ্রমণের ঘুমের কিছু কাজা দিলাম হোটেলে এসে। বিকেল ৩টার দিকে কয়েক ওয়াক্ত নামাজেরও কাজা দিলাম। কথা ছিল বিকেলে নাসির আসলে সে আমাদের নিয়ে বাইরে ঘুরিয়ে দেখাবে । কিন্তু সে আসতে পারল না, টেলিফোন করে জানালো। তাই সন্ধ্যা ৬টার দিকে ভাবলাম থাক, একাই বেরোই, দেখি না কি হয়। আমার থাইল্যান্ড বা ব্যাংকক ভ্রমনের প্রধানতম উদ্দেশ্য ছিল ব্যাংককের মুসলমানদের এবং তাদের জীবন যাত্রা দেখা। তাই আজকের এই বিকেলে প্রথম গন্তব্য নির্ধারণ করলাম মাসজিদ হারুন নামে একটা মসজিদের দিকে। যেখানে মালয়েশীয় পাসপোর্টধারী জনৈক বাসিজ জইনুদ্দিন আমাকে এ মসজিদের ঠিকানা দিয়েছে এবং এ সময় তিনি এখানে থাকবেন বলেছেন। আমি আমার হোটেল থেকে বেরুনোর সময় চাবি জমা দিয়ে কাউন্টার থেকে জেনেছিলাম যে মসজিদ হারুন এ কিভাবে যেতে হবে। মসজিদ হারুন যেহেতু সচারাচর চেনার কথা নয়। তাই এই মসজিদটি জি,পি,ও থাই ভাষায় জি,পি,ও বা পোষ্ট অফিসকে বলা হয়। পাই,সি,নিকান।
রাস্তায় বেরিয়ে মজাটা টের পেলাম। ব্যাংককের রাস্তায় একজন ইংরেজী জানা লোক খুজে পাওয়া শুধু জটিলই নয় বলা যায় অসম্ভব। যত সুন্দর স্মার্ট ভদ্রলোক বা ভদ্র মহিলাই দেখেন না তিনিও ইংরেজী জানেন না। আমি শেষ পর্যন্ত কোন বাক্য ব্যবহার না করে শুধু কয়েকটা শব্দ ব্যবহার করতাম জি,পি,ও পাই,সি,নিকান। হয়তো বা আমার উচ্ছারণ যথাযথ হচ্ছেনা বিধায় সেটাও বঝতে পারলো না। দু একজন হয়ত পাই,সি,নিকান শুনে পোষ্ট অফিস বুঝেছিল আর ইশারায় উত্তর দিল যে এখানে আশে পাশে কোন পোষ্ট অফিস নেই। কাউকে মসজিদ ও বললাম, থাই ভাষায় (মাসঈদ) ও বললাম। মুসলিম বললাম, দুহাত তুলে তকবীর দেওয়ার অভিনয় করলাম। কিন্তু এতে কেউ যদিও দু একটি বিচ্ছিন্ন শব্দ বুঝলো কিন্তু পোস্ট অফিস, মসজিদ, মুসলীম এগুলোর পরস্পর সম্পর্ক কি কিছু বুঝলো না বিধায় একাকার হয়ে গেল। আমি প্রায় দেড় ঘন্টা রাস্তায় এদিকে ঘুরা ঘুরি করলাম। একবার একটা লোক ১টা ২টা ইংরেজি শব্দ দিয়ে বলেছিলো যে আমাকে ৭৩নং বাসে যেতে হবে। সেই রোডে ৭৩নং কোন বাস চোখে না পড়ায় তার কথায়ও আমি আস্থা আনতে পারিনি যে এটাই সে রোড। যদিও এই ৭৩ নং বাসের কথা হোটেল কাউন্টারেও শুনেছিলাম। অবশেষে আমাকে টেক্সিতে যেতে মনস্থ করতে হলো। যদিও শুনেছিলাম যে, টেক্সি ওয়ালারা জালিয়াতি করে।
ব্যাংককে দুধরনের টেক্সি আছে। ১টা হলো ৩ চাকাওয়ালা। পেছনে মিটার টেক্সি অথাৎ মালয়েশীয়, সিংগাপুর বা অন্য উন্নত দেশের মতো প্রাইভেট কারের মতো চার চাকা ওয়ালা। আমি এ চার চাকাওয়ালা টেক্সিই নিলাম। ডাইভারকে পাই,সি,নিকান এবং জি, পিঁ, ও দুটোই বললাম। মনে হলো সে বুঝেছে, সে হাতের আঙ্গুল দিয়ে আমাকে ৮ দেখালো আমি চিন্তা করার সময় পেলাম না । পেছনে আমার ব্যস্ততা আছে।
এখন আমার আর কোন বিকল্প নেই। টেক্সিতে উঠে ভাবতে বসলাম। ৮মানে কত হতে পারে, ৮ বার্থ হবে, না ৮০ বার্থ হবে। হয়তো বা আবার ভাবলাম ৮-ও হতে পারে । ৮ বার্থ মানে বাংলাদেশী ১৩/১৪ টাকা। তাছাড়া ভাববার বিষয় ছিল-টেক্সিওয়ালা কোথায় নিয়ে থামিয়ে দেয়, সে আসলে চিনলোতো? আমার সন্দেহ ঘনীভূত হলো যখন দেখলাম, সে এই গলি ও গলি করছে। এক সময় কিছুটা ভয় পেয়ে তাকে বললাম, তুমি কোথায় নিচ্ছ? আমাকে নামিয়ে দাও। সে আমার কথা না বুঝলেও বিরক্তিটা টের পেল । সে বললো জি,পি,ও ওকে? পাই,সি,নিকান ওকে? অথাৎ তুমি জি,পি, ও যাবে তো”পোস্ট অফিস যাবা তো? আমি মাথা উপর নীচ করলাম। সে বললো জি, পিঁ, ও যেতে হলে ১০০ বার্থ দিতে হবে। স্বভাবতই আমি আশ্চার্য হলাম তার ৮-কে ৮০ ও যদি ধরি তবুও কোথায় সে ৮০। সে ১০০ বার্থ বলছে কেন? এখন আমি বললাম তুমি না বলেছ ৮০ বার্থ তখন সে বললো ওকে, ৮০ বাথই । পরে শুনলাম টেক্সিতে এই ভাড়া ৪০ বার্থ এর উপরে নয়, আর বাস ভাড়া মাত্র সাড়ে ৩ বার্থ । হায়! আল্লাহ কোথায় সাড়ে ৩ বার্থ, কোথায় ৮০ বার্থ । সে যাক, এজি, পি, ও থেকে কিছুক্ষণ খোঁজা-খুঁজির পর আমি হারুণ মসজিদ খুঁজে পেলাম। তবে মসজিদটি ছিল একটি গলির ভিতর । এই গলির দিকে ঢুকতে একবার হোঁচট খেলাম। গলির একস্থানে কিছুটা আলো আঁধারী, কিছুটা আবাসিক গলির এক কোনায় এক যুবতী হাফ প্যান্ট পরা এবং গায়ে সেন্টু গেঞ্জির মতো একটা গেঞ্জি পরা, চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে আছে। তার আসে-পাশে আরো ২/১ জন যুবক কিশোরীও আছে । আমি কিছুটা ভয় পেয়ে
গেলাম। কোথায় এলাম আমি, কোন দুর্ঘটনায় নিপতিত হবার আশঙ্কা এলো। ডান দিকে এগিয়ে কিছুদূর যেতেই হারুন মসজিদের সামনে এক বৃদ্ধ হুজুর পেলাম। চেহারা, সুরত ও জামা- কাপড় কিছুটা বাংলাদেশী। ব্যাংককে কারো সাথে কথা বলার আগে যে প্রশ্নটা করতাম সেটা হলো তুমি কি ইংরেজী জানে কিনা। বুড়ো হুজুর বললেন, তিনি ইংরেজী জানেন না, তবে উর্দু জানেন । বুড়োর সাথে উর্দুতেই আলাপ হচ্ছিল। আমি বললাম আমি জইনুদ্দিন, নামক জৈনক ভদ্রলোককে খোঁজ ছিলাম, যিনি আমাকে এই মসজিদের ঠিকানা দিয়েছিলেন। বুড়ো হুজুর জইনুদ্দিন নামে এখানে কাউকে চিনেন না বলে জানালেন। তার সাথে আলাপের মিনিট খানিকের মধ্যে আমি বাংলাদেশী জেনে তিনি বাংলায় বললেন তুমি বংলা জান না? আমি বললাম অবশ্যই। তিনি বললেন আমি বার্মিজ, ভাঙ্গা বাংলা জানি। বুড়োর সাথে আমার বাংলায়ই আলাপ হলো । তিনি হয়তো জানতে চাইছেন, আমি কখনো বার্মা গিয়েছি কিনা। বুড়ো হুজুরকে বিদায় দিয়ে আমি মসজিদের দোতলায় উঠলাম। দেখলাম, সেখানে ১০/১২ জন লোক বসে আছে। তাবলীগ জামাতের কাজে ব্যস্ত। আমার সেই জইনুদ্দিন সাহেবও সেখানে আছেন।
যিনি আলোচনা করছেন তিনি উর্দুভাষী আলোচনা রাখছেন উর্দুতে । অত্যন্ত তেজদ্দীপ্ত এবং প্রেরনাদায়ক ভাষা এবং শব্দের মাধ্যমে বক্তৃতা করছেন । আমি নিজেই মোহিত হয়ে গেলাম। শেষে মানুষের কল্যাণের শপথে জীবন উৎসর্গ করার মানসিকত কি চিল্লার কোন অংশে কম? অবশ্যই নয়। সৃষ্টিকর্তা, ধর্ম মানব বল্যাণ, শান্তি এসবই কিন্ত একে অপরের পরিপূরক ।
সে যাক, তাবলীগ জামায়াতের প্রোগ্রাম চলাকালেই জইনুদ্দিন সাহেবের কানের কাছে আমার মুখ নিয়ে বললাম, ”প্রোগ্রাম শেষ হতে কি দেরী হবে? ” তিনি বললেন, ”না একটু পরেই শেষ হয়ে যাবে।” হলোও তাই । ফেরার সময় জায়নুদ্দীন সাহেব নিজে আমাকে বাসষ্ট্যান্ড পর্যন্ত এগিয়ে দিলেন । বাস ভাড়া মাত্র সাড়ে ৩ বার্থ। যেখানে টেক্সি ভাড়া ৮০ বার্থ । বাস ভাড়া সাড়ে ৩ বার্থ মানে সেটাই সর্বোচ্চ লোকাল বাস ভাড়া অর্থাৎ ব্যাংকক শহরে আপনি পাবলিক বাসে এ মাথা থেকে ঐ মাথা পর্যন্ত যেখানেই নামেন ভাড়া মাত্র সাড়ে ৩ বার্থ ।
পরদিন ভোর ৬টার দিকে ফরজ নামাজ পড়ে বিচানায় গা এলিয়ে দিয়ে ভাবনার সাগরে ডুর দিলাম। কোথায় বাংলাদেশ, বগাদিয়া গ্রাম কোথায় আমার মা-বোন, কোথায় কায়ালালামপুর, আর কোথায় আমি। হঠাৎ খুব কড়া শব্দে টেলিফোন বেজে উঠল। চমকে উঠলাম। নিশ্চিত ধরে নিলাম, নাসির ফের করেছে। কারণ ব্যাংকক শহরে নাসির ছাড়া আমাকে ফোন করার কেউ নেই । আর নয়তো কোন রং নাম্বার হতে পারে, ডান হাত এগিয়ে দিলাম টেলিফোন সেটের দিকে । নারী কষ্ঠ পেলাম জানতে চাইছে এটা কি ২০৩নং রুম? বললাম, ইয়েস । কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে নাসিরের কষ্ঠ পেলাম। সে আরবীতে কথা বলছে, কিন্তু সে ভাল আরবী জানে না, তাই কথাগুলো ভালভাবে বুঝতে পারছিলামনা, কিছুটা বিরক্ত লাগলো, বললাম, তুমি ইংরেজীতে কথা বলছো না কেন। তারপর সে ইংরেজীতে বলতে লাগলো । আমাকে বললো, আমি যেন প্রস্তুত হই এবং আমার পাশের কক্ষে অবস্থান কারি আমাদের ইউনিভার্সিটির ছাত্র আফ্রিকা মহাদেশের মালাওই দ্বীপবাসী নাসিলা কে বলে রাখি প্রস্তুত হতে। আমরা সবাই মিলে থাই মুসলিম স্টুডেন্ট এসোসিয়েশন এর প্রেসিডেন্ট শূকরী সারীম এর বাসায় যাব। কিছুক্ষণের মধ্যে নাসির চলে এলো তার সাথে এলো ইউনিভার্সিটিতে তার রুমমেট আফ্রিকান বাকালি। রওয়ানা হওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই আমরা ব্যাংকক শহরস্থ হাই ওয়ে তে উঠে পড়লাম। ব্যাংকক শহরস্থ হাই ওয়ে কথাটা একটু বিপরীতধর্মী মনে হচ্ছে নাকি? শহরে আবার হাই ওয়ে হয় কিভাবে। হ্যাঁ শহরেই রয়েছে হাই ওয়ে এবং প্রকৃত অর্থে। অর্থাৎ উঁচু রাস্তুা। হ্যাঁ ব্যাংকক শহরের পুরো শহরে জুড়ে মাথার উপর হাই ওয়ে রয়েছে। নীচে শহর-বন্দর, দোকানপাট এবং রাজপথ। এই হাই ওয়ে মূলত তাদের জন্য, যারা শহরের বাইরে বাইরে যেতে চান এবং এ রাস্তা ব্যবহারের জন্য আলাদা টোল বা সড়র কর দিতে হয়।
সে যাক, সকাল ১০টার দিকে আমরা থাই মুসলিম স্টুডেন্ট এসোসিয়েশন এর প্রেসিডেন্ট শূকরী সারীম এর বাসায় পেীঁছে যাই। আমাদেরকে গাড়ীর ভেতরে বসিয়ে রেখে নাসির বাসার ভেতরে যায়। কিছুক্ষণের মধ্যে তিনি এবং শূকরী বেরিয়ে এসে আমাদেরকে নাস্তা করানোর জন্য রেষ্টুরেন্টের দিকে যাত্রা করে।
শূকরী এর পরনে ট্র্যাডিশনাল থাই লুঙ্গি। লম্বায় ৫ফু টের এর মত হবে। বয়সে ২০/২২ হতে পারে। তারা আমাদের একটা মুসলিম রেষ্টুরেন্টের নিয়ে গেল। রেষ্টুরেন্টের দেয়ালে এখানে-সেখানে আরবী ক্যালিওগ্রাফী, কালিমা তায়্যিবা, আল্লাহ, মুহাম্মদ, আয়াতুল কুরসী ফ্রেমে বাঁধানো আছে। এছাড়াও কাবা শরীফ, মসজিদে নববীর ছবি আছে। রেষ্টুরেন্টের মালিকের বয়স ৪০/৫০ এর মত হবে। মুখে দাড়ি-গোফহীন। মাথায় সাদা সুতি নেটের টুপি পরে এক বালিকা শিশুকে কোলে নিয়ে আমাদের সাথে হাত মিলাতে এলেন। তিনি আরবী-ইংরেজী কিছু জানেন না। তার সাথে ভাব বিনিময়কালে দুটো জিনিসই আমাদের খুব পরিচিত ছিল এবং সে দুটো জিনিসই আমাদের পরম বন্ধু হিসাবে দুজন অপরিচিত ব্যক্তিকে এক করে দিয়েছে। যে দুটি পরিচিত জিনিস হলো সালাম এবং এক চিলতে হাসি। আমার কাছে এসময় মনে হতে লাগলো ইস আমরা কত আপন! আমরা আছি বিশ্বময়। আমি একজন মুসলমান। আমি একজন মানুষ। একজন মুসলমান হিসবে আমি পৃথিবীর যে প্রান্তেই যাই শুনতে পাব এই আসসালামু আলাইকুম, শুনতে পাই আযান ধ্ববনি। এ প্রসঙ্গে এক মজার গল্গ মনে পড়ে গেল। এক অশিক্ষিত লোক নাকি সৌদি আরব গিয়েছিলেন। সেখানে স্বভাবতই তিনি কারো কথা বোঝেন না সবাই আরবিতে কথা বলে। কিন্তু যখন নামায পড়তে গিয়ে সুরা ফাতিহা শোনেন তখন তার বড়ই পরিচিত মনে হয় তিনি মনে করে আলহামদুলিল্লাী সুরা হয়ত বাংলা। তিনি দেশে চিঠি লিখে বলেন এদেশের মানুষ শুধু আরবিতে কথা বলে, শুধুমাত্র আলহামদুলিল্লাহ সুরাটাই বাংলা।
আমি অন্য যে বিষয়টি আশ্চার্য হয়ে লক্ষ্য করছি সেটা হলো- ইংরেজি আন্তর্জাতিক ভাষা পৃথিবীর সকল দেশেই কমবেশী ইংরেজী ব্যবহার হয়ে থাকে। কিন্তু পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের ইংরেজী উচ্চারণ বিভিন্ন, বিস্তর পার্থক্য। কিন্তু পৃথিবীর অনেক দেশেই আরবী প্রচলিত, বিশেষত মুসলমানদের মধ্যে। আর কোরআন শিক্ষা তো স্বভাবতই সকল মুসলমান ফরজ মনে করে শিখে। মজার ব্যাপার হলো আরবী কথাবার্তা বা উচ্চারণের মধ্যে পার্থক্য নেই বললেই চলে। আর কোরআন তেলাওয়াতের সামান্যতম পার্থক্য নেই ।
হোটেল মালিকের সাথে আমাদের দু চারটি বাক্য বিনিময় হয়েছে। রেস্টুরেন্টে বেয়ারা মহিলা। বয়সে তরুণী। মাথায় এক চিলতে কাপড় স্কার্ফ। আমাদের সামনে সাদা ভাত এবং থাই পদ্ধতিতে রাঁধা গরুর গোশত; আর এল গরুর খুরা ও নলা দিয়ে তৈরি সুপ বা নেহারী। আহারপর্ব শেষে আমরা ঐ এলাকার একটি প্রাচীন মসজিদ দেখতে গেলাম। তারা আমাকে নিয়ে ব্যাংকক ইসলামী কলেজে যায় প্রদর্শনের জন্য। ইসলামিক কলেজ পরিদর্শন শেষে আমরা আবার গেলাম সুকরি সারিম এর বাড়ী। বেশ সুন্দর দোতলা বাসার সামনে লোহার গেট। এ বাড়ীতে সুকরি একাই থাকেন। এটা তার নিজের বাড়ী। তার পিতা মাতা বা অন্যরা থাকেন আলাদা বাড়ীতে। নিচতলায় মেহমান খানা বা ড্রয়িং রুম, বাথ রুম, কিচেন রুম, উপরে শোবার ঘর। সুকরির ড্রয়িং রুমে বসেই তার সাথে আমার আলাপ হয়। ছোট খাট একটি সাক্ষাৎকারের মত।
এক সময় আমরা বেরিয়ে পড়ি। গাড়ীতে এসে বসতেই মনে হলো দোজখখানায় ঢুকলাম। গরম কাহাকে বলে, উহা কত প্রকার ও কি কি। গাড়ীর এসি চালানো হলেও গরম কমলো না। পথিমধ্যে গাড়ী থামানো হলো। সুকরি নেমে গিয়ে এক থলে বরফ কিনে আনলেন ।
কিছুক্ষণের মধ্যে আমাদেরকে নিয়ে যাওয়া হলো থাই মুসলিম স্টুডেন্ট আসোসিয়েশন – এর সাবেক সেক্রেটারী জেনারেল ব্রাদার দাউদ এর বাসায়। দাউদ তার পিতা মাতার সাথেই বাস করে। তার আলাদা কোন বাড়ী নেই। তবে তার পিতার বাড়ীটি বেশ বড়সড়। আমরা বৈঠকখানায় বসলাম। কিছুক্ষণ পর গ্লাসে করে বরফ দেয়া পানীয় আনা হলো। প্রচন্ড গরমে বরফ দেওয়া পানীয় অমৃত সুধা মনে হতে লাগলো। আমার মনে হতে লাগলো যদি আরেক গ্লাস খেতে পারতাম। সে সময় উদাউদ বাড়ীতে ছিল না। তার পিতাই আমাদের সাথে কথাবার্তা বলেন। আমাদের সাথে মানে নাসির এবং সুকরীর সাথে। আমরা শুধু বসে বসে শুনলাম। কিছুক্ষনের মধ্যে আমরা আবার রওয়ানা হলাম ব্যাংককের মুল শহরপাণে কিন্তু গাড়ীর ভেতরে প্রচন্ড গরমে আমার অবস্থা কাহিল। বেলা সাড়ে ১২টার দিকে ব্যাংককের অধিকাংশ মুসলিম এ এলাকায় বাস করে বিশাল এলাকা নিয়ে মুসলমান বাস করে। মুসলমানরা এই এলাকার নাম দিয়েছে দারুল ইহসান। আমরা গাড়ী থেকে নামার কয়েক মিনিটের মধ্যে এক পৌঢ়া এবং এক স্মার্ট কিশোরীকে আসতে দেখলাম। বৃদ্বের পরনে শার্ট প্যান্ট ঢিলাঢালা, মাথায় কালো ক্যাপ। মহিলার পরনে সারাং বা লুঙ্গিও মতো, গায়ে কামিজ এবং মাথায় ওড়না বা স্কার্ফ আর কিশোরীটির পরনে প্যান্ট শার্ট ইন করা, মাথায় স্কার্ফ। মুখাবয়ব বেশ সুন্দর, চোখ দুটি টানা টানা। আমার কেমন যেন চেনা মনে হলো। ইতোমধ্যেই নাসির আমাদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বললো, আমার আব্বা, আম্মা, এবং ছোট বোন। আমরা সালাম দিয়ে নাসিরের আব্বার সাথে হাত মেলালাম। নাসিরের ছোট কিশোরী বোনটি আমদেরকে সালাম দিলো এবং হাত তুলে সম্ভাষণ জানালো।
কিছুক্ষণের মধ্যে আমরা দারুল এহসান মসজিদে পোঁছলাম। আমি যার পর নাই তৃষ্ণার্ত ছিলাম। মনে মনে কেবল পানির সন্ধান করছিলাম। ভাবলাম মসজিদে গিয়ে চুপে চুপে অজু করার সয়ম সাপ্লাই পানি আকন্ঠ পান করে নেব। এদেশে কেউ সাপ্লাই পানি খায় না। কিন্তু মসজিদে গিয়ে দেখলাম না, আমাকে চুপে চুপে খেতে হবে না। পানির যথেষ্ট ব্যবস্থা আছে। ৩টা বড় বড় কনটেইনার ভর্তি ফ্রিজের পানি সাথে গ্লাস দেয়া। মনের মতো করে পানি- খাওয়া যায়। আমি ৪ গ্লাস পানি খেলাম। অজু করে দোতলায় গেলাম জুমার নামাজ পড়ার জন্য। ইমাম সাহেব মুখে ৩-৪ ইঞ্চি লম্বা দাড়ি, গায়ে হাতাওয়ালা শার্ট। থাই ভাষায় প্রথম ও দ্বিতীয় খোতবা প্রদান করলেন। থাই ভাষায় এই খোতবা যখন শুনছিলাম মনে হচ্ছিল আমি গভীর অন্ধকারে নিমজ্জিত আছি। খোতবার মধ্যে যখন আরবীতে কোরআনের আয়াত বা হাদীস পড়ছিলেন তখন মনে হচ্ছিল অন্ধকার রাতে বিদ্যুতের ঝিলিক।
নামাজ শেষে মধ্যাহ্ন ভোজন পর্ব শুরু হলো মসজিদের মধ্যেই। তারপর মসজিদ সংলগ্ন বৈঠকখানা এবং পাঠাগারে গেলাম যেখানে চা পর্ব শুরু হলো, সাথে পরিচিতি অনুষ্ঠান। আমাদেরকে পেয়ে সকলে যেন খুব খুশী। আমার পাশে বসেছিলেন এক থাই পুলিশ অফিসার তার নাম আনসার। কথায় কথায় ভদ্রলোক বারবারই আমাকে বললেন, ভাই তোমরা খুব সুখে আছ, তোমাদের দেশে ৮৫% মুসলিম। এছাড়াও আমরা পরিচিত হলাম উস্তাদ আলি এর সাথে মিশরীয় বংশদ্ভূত এই উস্তাদ আলি ৩০ বছর যাবৎ থাইল্যান্ডে আছেন। মিশরের “ইখওয়ানুল মুসলেমুন” নিষিদ্ধ হয়ে যাবার পর ইখওয়ান নেতৃবৃন্দ পৃথিবীর আনাচে-কানাচে ছিড়িয়ে পড়েন। উস্তাদ আলি এসেছিলেন দক্ষিণ থাইল্যান্ডের ফাতানী রাজ্যে ইসলামের দাওয়াতকে সম্প্রসারণ করার জন্য কিন্তু থাই সরকার তাকে দক্ষিণ থাইল্যান্ডে যেতে দেননি। তাই তিনি ব্যাংককেই থেকে যান এবং ইসলামের দাওয়াত দিতে থাকেন। পুলিশ অফিসার আনসার সাহেবের সাথে আমার দীর্ঘক্ষণ আলাপ হয়। ভদ্রলোক বেশ আবেগপ্রবণ এবং ধর্মীয় দিকে বেশ অনুভূতিশীল। কোরআন হাদীসের ওপর তার দখল বেশ ভাল। প্রথমে তাঁর সাথে আলাপ হচ্ছিল ইসলামের ব্যাসিক প্রিন্সিপাল-এর ওপর। এতে তার কোরআন হাদীসের দখল দেখে ভাবলাম সংখ্যালঘু মুসলিমরা সাধারণত এসব শিখে নেন। কিন্তু কথার মোড় যখন বিভিন্ন দিকে যাচ্ছিল সে সব বিষয়ে ও তাঁর কোরআন হাদীসে ভালো জ্ঞান দেখলাম। এক পর্যায়ে আমাকে জিজ্ঞেস করলো, তুমি বিয়ে করছে কি না? আমার উত্তর শুনে তিনি কোরআন হাদীসের বেশ কিছু দলিল পেশ করলো বিয়ের ফজিলত বর্ণনা করে এবং শেষে পরামর্শ দিলো আগামী বন্ধেই দেশে গিয়ে ঐ কর্মটি সম্পাদন করার জন্য। একটি অমুসলিম বিশেষজ্ঞ থাইল্যান্ডের মতো দেশের একজন পুলিশ অফিসারের এই ইসলামী জ্ঞানে সত্যিই আমি মোহিত হলাম। কোথায় আমরা। ৮৫% মুসলিম অধ্যুষিত দেশের মুসলমানেরা।
উস্তাদ আলীর সাথে আমাদের আলাপ চলে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত একনাগাড়ে। মাঝে এক দু’বার চা চললো এবং ছবি তুললাম। চমৎকার স্পষ্ট এবং সুন্দর আরবী বলেন। অনেকগুলো গুণসম্পন্ন। আমাদের এই ৪ ঘন্টার আলাপচারিতার পুরো সময়টাই তিনি ছিলেন হাস্যোজ্জ্বল, অত্যন্ত প্রাণবন্ত। বলতে গেলে তার অক্লান্ত পরিশ্রম এবং চেষ্টায়ই ব্যাংককের মতো এই স্থানে দারুল এহসান গড়ে উঠেছে। তিনি থাইল্যান্ডের ৭২টি রাজ্যের প্রতিটি রাজ্যেই সফর করেছেন এবং বললেন যে, আলহামদুলিল্লাহ কম বেশি প্রতিটি রাজ্যেই মুসলমান আছে। মসজিদ মাদ্রাসা আছে। মিসরীয় এই শায়েখের দাওয়াতী, তৎপরতার মধ্যে সাহিত্য রচনাও ছিল। থাই ভাষায় তিনি প্রচুর বই লিখেছেন। একটি প্রকাশনা সংস্থা গড়ে তুলেছেন। নিয়মিত মাসিক পত্রিকা বের করছেন এবং আরবী ছাপাখানাও করেছেন এই ব্যাংকক শহরে। আমি প্রায় ছোটখাট একটা সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে অনেক তথ্য পেয়েছিলাম। ভদ্রলোক আমার প্রতি খুব আগ্রহ দেখালেন এবং বয়সে তাঁর ছেলের সমান হলেও খুব সম্মান করলেন। আমি থাইল্যান্ডে মুসলমানদের ওপর ইংরেজীতে কোনো প্রবন্ধ আছে কি-না জানতে চাইলে তিনি তার জানা নেই বলে জানালেন। তাছাড়া তিনি ইংরেজী জানেন না বললেই চলে। তবে আরবীতে তাঁর নিজের লেখা প্রবন্ধ পড়ে নাসিরের মাধ্যমে পাঠাবেন বলে আমাকে আশ্বস্ত করলেন। সন্ধ্যা ৬টার পরে আমরা তার কাছ থেকে বিদায় নিলাম। বারবারই তার সুন্দর হাসিমুখ, স্পষ্ট আরবী উচ্চারণ আমার মনের পর্দায় ভেসে উঠতে থাকবে।
সন্ধ্যার পর আমাদের দাওয়াত ছিল নাসিরের বাসায়। মাগরিবের পর পৌছলাম। নাসিরের আব্বাও খুর ভাল আরবী জানেন। ইংরেজী জানেন না। তিনি প্রায় ১০ বছর মিশরে ছিলেন। যদিও তাঁর ছেলে নাসির আরবী জানে না, আসলে নাসির বড় হবার আগেই তাঁরা মিসর ছেড়েছিলেন। নাসিরদের বাসায় আমাদের সাথে আরো দাওয়াত ছিল থাই মুসলিম স্টুডেন্ট এসোসিয়েশন এর প্রেসিডেন্ট শূকরী সারীম, এবং সাবেক সেক্রেটারী জেনারেল দাউদ এবং বর্তমান কয়েকজন নেতা। আমরা মোট ১০/১২ জন ছিলাম। দারুণ একটা ভোজন পর্ব চললো। সেখানে যা যা খেলাম আমি সবকিছুর নাম আমার ডাইরীতে নোট করে রাখলাম। তন্মদ্ধে ছিল খই, রামবুথান, (লিছুর মত তবে অনেক বড়) চা, ড্রাই কেক, আংগুর (থাই ভাষায় আংগুনা, ধনিয়া পাতা, স্যান্ডউইচ এবং পাকা গাবের মতো একটা ফল। সকলের মধ্যে আমিই বোধহয় সবচে বেশী খেলাম। প্রথমেই ছোট ছোট ১০/১২ টা স্যান্ডউইচ খেয়ে ফেললাম।
জীবনে স্যান্ডউচ আরো খেয়েছি কিন্তু এত স্বাদ কখনো পাইনি, রামবুথানও খেলাম মনের মতো করে- তারপর আংগুর। লক্ষ্য করলাম, আমার পেট ফুলে উঠেছে। তারপর বসলো আড্ডা। আমি এ সময় কিছু কাজ করলাম। থাই মুসলিম স্টুডেন্ট এসোসিয়েশন এর প্রেসিডেন্ট শূকরী সারীমকে তাদের সাংগঠনিক কর্মকান্ড দেখাতে লাগলেন। তাদের ৫ দিনব্যাপী একটা শিক্ষা শিবিরের কর্মসূচী দেখলেন, থাই ভাষায় লিখিত কর্মসূচীটি তিনি অনুবাদ করে দিচ্ছিলেন । কর্মসূচীর মধ্যে ছিল পরিচিত, কোরআন শিক্ষা, পরিকল্পনা তৈরি, আলোচনা, শিক্ষা সফর ও সেমিনার। আলোচনাগুলোর আলোচক ছিলেন থাই মুসলিম স্টুডেন্ট এসোসিয়েশন এর সাবেক নেতৃবৃন্ধ যারা অনেকেই এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। আলোচনার বিষয়গুলোর মধ্যে ছিল, আপনি কিভাবে একজন নেতা বা সংগঠক হতে পারবেন’, ‘বর্তমানে বিশ্ব এবং মুসলিম ছাত্র’, ‘আপনার সমস্যার সমাধান করবেন কিভাবে’, ইত্যাদি।
রাত ১০টার দিকে আমাদের আসর শেষ হলো তখন প্রস্তাব এলো ডিনারের আমি বললাম মাথা খারাপ এতক্ষণ কি চললো তাহলে। নাসির বললো, এটাতো একটা চা-চক্র। সে যাই হোক আমাদেরকে ডিনার করতে যেতে হবে এক হোটেলে। রওয়ানা করলাম আমরা ১০জন। নাসিরদের দুই গাড়ীতে ৫ জন করে ১০ জন উঠলাম। আমি যে গাড়ীতে উঠলাম সেটা ড্রাইভ করছিল নাসির, অন্যটা করছিল দাউদ । আমাদের গাড়ি আগে রওয়ানা করে। আমরা কিছু দূর অপেক্ষা করি। কিন্তু দাউদ আমাদেরকে দেখতে পায়নি সে খুব দ্রুত গাড়ী চালিয়ে আমাদের অভারটেক করে। আমার তখনই যেন কেমন মনে হচ্ছিল যে তিনি বেপরোয়া গাড়ী চালাচ্ছেন। আমরা তাদের পিছু নিলাম। হ্যাঁ কিছু দূর যেতে দুর্ঘটনা করে বসলো দাউদ। মালয়েশিয়াতে এবং সিংগাপুরেও তাই দেখেছি। এই ব্যাংককেও যন্ত্রদানব ট্রাকের সাথে বেপরোয়া প্রতিযোগিতা দেখাতে গিয়ে দুর্ঘটনা করে বসলেন, যদিও পরে পুলিশ রিপোর্টে ট্রাক ড্রাইভার নিজের দোষ স্বীকার করলেন। সে যাক, আমরা দুর্ঘটনা দেখে নেমে পড়লাম।৪/৫ মিনিটের মধ্যে শাঁ শাঁ করে পুলিশ চলে এলো। ট্রাক ড্রাইভার বা কার ড্রাইভার কেউ পালালেন না। মালয়েশিয়াতেও দেখেছি এক্সিডেন্ট করে উভয় গাড়ির ড্রাইভার গাড়ী সাইড করে দাঁড়িয়ে পুলিশের অপেক্ষা করে। এখানেও তাই দেখলাম। পুলিশ এসে আমাদের দু’জন বিদেশীর পাসপোর্ট দেখলো, তারপর উভয় চালকের লাইসেন্স দেখে কিছু লিখে নিল, জিজ্ঞাসাবাদ করলো এবং বললো তোমরা নিজেরা আপোস করবে, না মামলা করবে। উভয় ড্রইভার বললো, আমরা আগে আপোষের চেষ্টা করবো। পুলিশ এতে সম্মতি জানিয়ে চলে গেল। ইতিমধ্যে ট্রাক ড্রাইভার তার দোষ স্বীকার করলো, তারপর উভয়ের ইন্স্যুরেন্স কোম্পানীকে ফোন করা হলো। ইন্সুরেন্স কোম্পানীর লোক এসে সব দেখলো, আলাপ-আলোচনা করলো। গাড়ীর আহত অংশের ছবি তুলে নিয়ে কিছু কাগজপত্রে সই নিয়ে চলে গেল। এসব করতে আমাদেরকে প্রায় ২ঘন্টা ব্যাংককের রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকতে হয়েছে।
মজার ব্যাপার হলো, এ সময়ই আমি রাতের ব্যাংকক দেখার বিরাট একটা সুযোগ পেয়ে গেলাম । আমার বন্ধুরা যখন পুলিশ এবং ইন্সুরেন্স কোম্পানীর সাথে আলাপ-আলোচনা করছিল, তখন আমি ব্যাংককের রাস্তায় হাঁটাহাঁটি করছি। রাত ১১-১২. ব্যাংককে সন্ধ্যা হয় ৬টায় অর্থাৎ রাত ১১/১২ মানে গভীর রাত। এসময় রাস্তার নিশাচরী মেয়েদের দেশেছিলাম এবং আমার ধারণা যদি ভুল না হয় তবে এরা ছিল পতিতা। রাত ১২টার সময় হাফপ্যান্ট এবং গেঞ্জি বা অন্য যৌন উত্তেজনাবর্ধক পোষাক পরে কোন মেয়ে রাস্তায় বেরুলে তাকে পতিতা ভাবাটা অন্যায় হবে না, তাও ব্যাংকক শহরে। তাছাড়া তারা যে চলে যাচ্ছিল সেটাও না তাদেরকে দেখলাম ঘুরাঘুরি করতে। এদিক-সেদিক তাকাতে। আমাদের জটলা দেখে কয়েক সেকেন্ড দাঁড়াতেও দেখেছি। এমনকি চোখাচোখিও হচ্ছিল। ২/১টা মেয়েকে এমন দেখেছি পরনে নিতম্ব বরাবর স্কাট তাও পাতলা এবং টাইট। উপরে শরীরের সাথে লেপ্টে থাকা গেঞ্জি, তাও বুকের অর্ধেক খোলা। তাদেরকে দেখে আমার খুব কেীতুহল হলেও বারবর খুব ভয় করছিল। তবে আমার বুকে বল ছিল যে, আমার সাথে একদল যুবক বন্ধু আছে। আর আমি তাদের কাছ থেকে দূরেও যাচ্ছিলাম না। একবার একটা মেয়ে হয়তো বা আমাকে খরিদ্দার জাতীয় কিছু কিনা জানিনা, সে আমার সামনে দিয়ে ২ বার চক্কর দিলো। তারপর দূরে একটা থামানো গাড়ীর আড়ালে কিছুক্ষণ দাঁড়ালো, তারপর অন্যদিকে চলে গেল। রাত ১২ট ১০মিনিটের দিকে আমরা ঝামেলা চুকিয়ে আমাদের ডিনারের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলাম। ফাঁকা রাস্তা ২/৪টি প্রাইভেট কার, আর টেকসি।
প্রায় ৩০ মিনিটপর আমরা আমাদের ডিনারের গন্তব্যে পৌঁছলাম। হোটেলের মালিকের নাম জাকারিয়া তিনি থাই মুসলিম স্টুডেন্ট এসোসিয়েশন এর প্রতিষ্ঠাতা কার্যকরী পরিষদ সদস্য। ভদ্রলোক আমার সাথে বেশ আগ্রহের সাথে কথা বললেন। আহারের পর তিনি বর্তমান নেত্ববৃন্দের সাথে আলাপচারিতা তথা আড্ডায় বসলেন। ভদ্রলোক বেশ আবেগপ্রবণ, শুধু বেশ নয় খুব। তাদের আলোচনা হলো থাই ভাষায়। আমি বা আমরা ৩ জন যারা বিদেশী ছিলাম কিছুটা বিরক্ত হচ্ছিলাম। কারণ তাদের আলোচনা চললো রাত আড়াইটা পর্যন্ত। আমরা সারাদিন ঘোরাঘুরি করে পরিশ্রান্ত। আমি কয়েকবার টেবিলে মাথা রেখে ঘুমাচ্ছি এমন অভিনয় করে বুঝাতে চাইলাম যে, আমার খুব ঘুম পাচ্ছে, কিন্তু এতেও তাদের বড় একটা বোধোদয় হলো না। তবে আমার কাছে এটাও মনে হয়েছে তারা কোন ঝগড়া মেটাচ্ছে বা ভুল বুঝাবুঝি দূর করছে। কারণ তাঁদের কথা বার্তায় বেশ আবেগ ছিল। অথবা জাকারিয় সাহেবের স্বাভাবই এমন। রাত আড়াইটার সময় আমরা ঝড়ভেজা পাখির মত ঝিমুতে ঝিমুতে হোটেলে এসেই চিৎপটাং। এবং নিমিষেই নাকডাকা ঘুম।
জাগলাম সকল ৯টায়। উঠেই ভাবতে বসলাম আজ ১২টার আগেই হোটেল ছাড়তে হবে। না হয় আরো ২৫০ বার্থ উঠবে কপালে। তাড়াতাড়ি দাঁত ব্রাশ এবং গোসল সেরে আগে ফজর নামাজ কাজা করলাম। তারপর কাপড়-চোপড় গুছিয়ে ১০টার পরই বিদায় ২০৪ নং কক্ষ। কাউন্টারে এসে ৫০০ বাথ পরিশোধ করলাম। তারপর ভাবছি কোন দিকে যাব। বাস টার্মিনাল, ট্রেন স্টেশন কিছুই চিনি না। গতকাল গাড়ী এক্সিডেন্ট করাতে নাসির দুঃখ প্রকাশ করে আমাকে জানালো যে, আজ সে আমাকে কোন সহযোগিতা করতে পারবে না। তাই আমাকে একাই ব্যাংকক মোকাকিলা করতে হবে। মনটা দুরুদুরু কাপছে। টেকসী নিলে হয়ত খুব বিপদ হবে না কিন্তু তাতে ২ ঘন্টাই আমাকে ফতুর হতে হবে। তাই ব্রীফকেইস হাতে নিয়ে ভাবছি কি করবো, কোনটা আগে করবো।




Comments