সিংগাপুরে কয়েকদিন
- AbuSayed Mahfuz
- Aug 16
- 16 min read
১৪ এপ্রিল বৃহস্পতিবার। পরীক্ষা চলছে, মাঝখানে লম্বা বিরতি। আবার পরীক্ষা ২১ তারিখে। পরীক্ষার পর অনেকগুলো পরিকল্পনা। মাথায় এলো সিঙ্গাপুর যাবার এটাই মোক্ষম সময়। যেই ভাবা সেই কাজ রাত ১ টার সময় ফোন করলাম সিঙ্গাপুরে অবস্থানকারী বন্ধু হাবিব ভাই এবং জুয়েল ভাইকে। পেয়েও গেলাম সাথে সাথে। জানালাম, ১৫ এপ্রিল রাতেই সিঙ্গাপুর আসছি। দিনে গিয়ে টিকেট কিনে আনলাম। রাত ১০ টায় ছাড়বে বাস।
১৫ এপ্রিল শুক্রবার। সারাদিন এটা-ওটা গুছালাম। মনের ভেতর কি যেন পিট পিট করছে। সন্ধ্যার পর আমার হ্রস্পন্দন বেড়ে গেল। মেপে দেখিনি, তবে মিনিটে ৮০ বারের কম হবে না বোধ হয়। খেতে গেলাম কেন্টিনে, খেতে পারলাম না ঠিকমত। আমার এ সমস্যা অনেক দিনের। কোথাও যাবার প্রস্তুতি নিলেই কেন যেন টেনশন শুরু হয়ে যায়।
বাস স্ট্যান্ডে গিয়ে দেখি, আমাদের ৩ ইন্দোনেশীয় বন্ধু। আমার সহপাঠি মুখতার সস্ত্রীক বাড়ি যাচ্ছে, অন্য দু’জন এসেছে তাকে সী অফ করতে। তাদের সাথে কিছুক্ষণ এটা-ওটা আলাপ শেষে বিদায় নিচ্ছিলাম, তখন মুখতারের বৌ হাত তুলে সম্ভাষণ জানায়। আমি যে মুখতারের ক্লাসমেট, ভদ্র মহিলা আগে থেকেই জানতেন। মুখতার সস্ত্রীক ঘুরে বেড়ানোর সময় তার সাথে আমার কথা হয়েছে কয়েকবার। কিন্তু ভদ্র মহিলা ইংরেজীর ই-আ আরবী কথাবার্তার আলিফও জানতেন না, তাই তাঁর সাথে কখনো নিতান্ত সম্ভাষণ বিনিময়ও হয়নি। বাসে উঠতে যাব, ’ন’টার গাড়ী ক’টায় ছাড়বে’ এ অবস্থা মালয়েশিয়ায়ও আছে। ১০ টায় ছাড়ার কথা থাকলেও প্রায় ৩০ মিনিট পর বাস আসে। কিন্তু আমার টিকিটে যে বাস নম্বর দেয়া ছিল এটা সে বাস নয়। পড়ে গেলাম চিন্তায়, ড্রাইভারকে জিজ্ঞেস করলাম ড্রাইভার বলল, এটাই যাবে সিঙ্গাপুর, অন্য কোনোটা নয়। আর আমাকে যে ১৩ নম্বর প্লাটফর্ম দেয়া হয়েছিল, এটা সে ১৩ নম্বর প্লাটফর্মেই এসেছে। এদিকে সমস্যা হলো ড্রাইভার ভাল ইংরেজী বলতে পারে না। তাকে প্রশ্ন করলে উত্তরে বললো এটাই যাবে সিঙ্গাপুর। কিন্তু আমি যখন পাল্টা প্রশ্ন করলাম যে, আমার বাস নম্বর তো মিলছে না, তখন দেখলাম তার ইংরেজী দৌড় শেষ। ভেতরে গিয়ে সিটে বসলাম, তারপর পাশের ভদ্র লোকের সাথে আলাপ করলাম সমস্যা সম্পর্কে। ভদ্রলোক চীনা, কিন্তু ইংরেজী জানেন না। এগিয়ে এলেন তার পাশে বসা তরুণী। সম্ভবতঃ স্বামী-স্ত্রী। তরুণীর বয়স ১৮/২০ বছর হবে। ইংরেজী মোটামুটি ভালই বলতে পারেন। তিনিই আমার ব্যাপারটা নিয়ে ড্রাইভারের কাছে গিয়ে চীনা ভাষায় কি যেন কথা বলে আমাকে বলেন, ’তুমি বসে থাক অসুবিধা নেই’। ভদ্র মহিলাকে ধন্যবাদ জানালাম।
তরুণীটি আমার উপকার করে আমাকে খুশী করলেও রাতের একটা বিরাট অংশ জুড়ে আমাকে এবং আমার আশেপাশের সহযাত্রীদেরকে কিছুটা বিরক্ত করেছিল। তরুণীর পাশে বসা যুবকটি তার স্বামী বা প্রেমিক যাই হোক না কেন, চীনাদের কাছে সেটা কোন সমস্যাই নয়, তাই বাস যখন শহর ছাড়িয়ে রাজপথে নামে এবং বাসের বাতি নিভিয়ে দেখা হয় তখন এই চীনা দম্পতি কিংবা যুগল তাদের যতটুকু সাধ্যে কুলিয়েছে ততটুকু অগ্রসর হয়েছে। বাসের বাতি নেভানো থাকলেও যাত্রীদের দিকে ফেরানো টেলিভিশনের উজ্জল আলোতে চীনা যুগলের আনন্দ-ফুর্তি কারো চোখে পড়তে তেমন বেগ পতে হয়নি। তাদের আনন্দ- ফুর্তি নিতান্ত নিঃশব্দও ছিল না। ওষ্ঠযুগলের মধুর সংঘর্ষে সৃষ্ট শব্দ টেলিভিশনের শব্দের ফাঁকেও শোনা যাচ্ছিল।
রাত ৩ টার দিকে আমরা মালয়েশীয় ইমিগ্রশন পার হচ্ছিলাম। আমি বাস থেকে ঝটপট নেমে গিয়ে নির্দিষ্ট কাউন্টারে আমার পাসপোর্ট এগিয়ে দিলে কর্তব্যরত অফিসার নেড়েচেড়ে মিনিট দুয়েক দেখলেন পূর্ণ প্রবেশ অনুমতি বা রি-এন্ট্রি ভিসা ঠিকমত আছে কিনা, দেখেই সীল মেরে দিলেন। কিছুক্ষণ পরই আবার সিঙ্গাপুর ইমিগ্রেশন পেলাম। প্রশ্ন করল, তুমি কি ছাত্র? তারপর একটা ফর্ম দিল পূরণ করার জন্য। ৫/৭ মিনিটেরর মধ্যেই ১৪ দিনের ভিসা দিয়ে বিদায় করে দিল। আমার সামনেই বসা ছিল সাদা চামড়ার কয়েক তরুণ, বয়স ২০/২৫ বছর হবে। আমার খুব ধারণা হচ্ছিল ইউরোপীয় হবে। ভাবলাম ছাত্র হতে পারে। কিন্তু আলাপ করার কোন ফুরসত পেলাম না। সিঙ্গাপুর ইমিগ্রেশনে যখন দেখলাম আমার মত তারাও ফর্ম পূরণ করছিল আমার পাশাপাশিই, তখন কেন জানি আমার ধারণা বন্ধমূল হচ্ছিল। বাসে ফিরে আসার পর আমার ঠিক সামনের ছেলেটিকে বললাম, তুমি কি ছাত্র? সে বলল হ্যাঁ। তার নাম ইসমাইল। তুর্কী। সে ফিলিপাইনের ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটিতে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে অনার্স করছে। সে তুর্কী শোনার পর আমার আরেকটু ভাল লাগল। আমাদের ক্যাম্পাসে হাতে গোনা যে ক’টা দেশের ছেলেরা বিশেষভাবে ভদ্র, নম্র ও ধার্মিক, তুর্কিস্তান তন্মধ্যে অন্যতম। ঝগড়াঝাটি, মারামারি করা, মেয়েদের পেছনে ঘোরা, কিংবা নিজের পেছনে ঘোরানো এসবের কোনটাতেই তারা নেই। ইসমাইলের সাথে অনেক কথাই হলো। আরো ভালো লাগলো। তার কথাবার্তাও ইসলামী সংস্কৃতির ছাপ আছে। কথার ভেতরে ইনশাল্লাহ, মাশাআল্লাহ, আলহামদুল্লিাহ, লক্ষ্যণীয়ভাবেই ব্যবহার করছিল। বিদায় মুহূর্তে ঠিকানা বিনিময় হলো।
ভোর ৪ টার সময় সিঙ্গাপুর শহরের কেন্দ্রস্থলে আমরা বাস থেকে নামি। সকাল হতে আরো ৩ ঘন্টা বাকী। ভাবছিলাম কি করবো। এই রাতে জুয়েল ভাইকে ফোন করে বিরক্ত করাও ঠিক হবে না, অথচ তার বাসাও চিনি না। আগে শুনেছিলাম সিঙ্গাপুর শহরে চোরর, ডাকাত কিংবা হাইজ্যাকারের ভয় নেই। তাই গন্তব্যহীন হাঁটলাম প্রায় ঘন্টা খানেক। এই নিশীথ রাতে সিঙ্গাপুর কেমন লাগে তা দেখছিলাম, কিংবা সময় কাটাচ্ছিলাম। রাতের সিঙ্গাপুর মূলতঃ টেকসীর দখলে বলা যায়, প্রচুর ভাড়াটে টেকসী ঘোরাফেরা করছে। প্রতিটি খালি টেকসীর চোখ আমার দিকে। এই নিঝুম রাতে একজন বনি আদম এগিয়ে যাচ্ছে। এক সময় কেমন যেন ভয় ভয় করছিল। চোর ডাকাত বা হাইজ্যাকারের নয়। এই এক ঘন্টা আমার কাছে অনেকটা প্রমাণিত হয়ে গেছে যে সিঙ্গাপুর শহরে কোন ডাকাত বা হাইজ্যাকার নেই। হয় হচ্ছিল পুলিশের। কোনো টহল পুলিশ যদি আমাকে ফলো করে, কোনো কারণ ছাড়া আমি ঘন্টাধিককাল কেন ঘুরে বেড়াচ্ছি ভবঘুরের মত। মন একটু একটু চাইছিল যত রাতই হোক, কিংবা জুয়েল ভাই যাই মনে করুক, ফোন করাই দরকার। পকেটে আগে থেকে বুদ্ধি করে কিছু সিঙ্গাপুরী কয়েন নিয়ে এসেছিলাম, কিন্তু সমস্যা হলো কোথাও কোন কয়েন বক্স খুঁজে পেলাম না। যেখানেই রাস্তার পাশে টেলিফোন সেট দেখে এগিয়ে গেলাম না কার্ড ফোন, কয়েন বক্স নেই।। এক সময় একটা দোকান খোলা পেলাম। সেভেন ইলেভেন পৃথিবীর উন্নত দেশগুলিতে এই সেভেন ইলেভেন দোকান আছে। আমেরিকান মালিকের অধীনে এসব দোকান ২৪ ঘন্টা খোলা থাকে আর থাকে নিত্যপ্রয়োজনীয় সকল দ্রব্য। দোকানের সামনে মেইন সড়কে ২/৩ জোড়া কপোত-কপোতী গায়ে হাওয়া লাগাচ্ছিল আর আড্ডা জমাচ্ছিল। ভাবলাম সেভেন ইলেভেন এর ভেতরে গিয়ে তাদের সহযোগীতা চাইব। কিন্তু এই নিঝুম রাতে শুধু শুধু বিরক্ত না করে প্রথমে একটা আমের রস কিনলাম, মুদ্রা বিনিময়ের সুযোগে জেনে নিলাম সিঙ্গাপুর শহরে কোন কয়েন বক্স আছে কিনা, তার কাছে ফোন কার্ড আছে কিনা, এবং আমার গন্তব্য কোন দিকে। উত্তরে ভদ্রলোক দুঃখ প্রকাশ করে বললেন, ফোন কার্ড শেষ হয়ে গেছে তাদের দোকানে। তবে আমি কিছুদূর সামনে এগুলেই একটা কেন্টিন খোলা পাব, সেই কেন্টিনের সামনেই কয়েন বক্স আছে। আর ভদ্রলোক যে দিকে দেখালেন সে দিক থেকেই আমি হাঁটতে হাঁটতে উল্টো দিকে প্রায় দেড় মাইল চলে এসেছি। আর কেন্টিনটা বা কয়েন বক্সের খোঁজে যেতে হলে আরো আধা মাইল যেতে হবে। তবু আমাকে যেতে হবে। ভোর হতে আরো ২ ঘন্টা বাকি। আর জুয়েল ভাইয়ের বাসাও আমি চিনি না।
মিনিট দশেক হাঁটার পর কেন্টিন পেলাম এবং কয়েন বক্সও পেলাম, তবে প্রথমে কয়েন বক্স চিনতে কষ্ট হয়েছিল। ছোট একটি বক্স, ব্যক্তিগত টেলিফোন সেটের চেয়ে সামান্য বড়। ইতস্ততঃ করতে করতে সাহস করে একসময় ফোন করেই বসলাম। ঠিক করে নিয়েছিলাম, ৩ বার রিং হবার পরই কেটে দেব। ফজর নামাজের সময় হতে আরো আধা ঘন্টার মত দেরী। ভাবলাম এ মধ্যে যদি জেগে যায় ভাল। হ্যাঁ ঠিক আছে। তারপর একই বিনীত সুরে ইংরেজীতেই জিজ্ঞেস করলাম, এটা কি জুয়েল ভাইয়ের বাসা? জুয়েল ভাই নিজেই কথা বলছিলেন, বললেন, ইয়েস, খুব খুশী হলাম। সাথে সাথে বাংলায় কাঁদো কাঁদো স্বরে বললাম, জুয়েল ভাই আমি মাহফুজ, এক ঘন্টা থেকে সিঙ্গাপুর শহরে ঘুরে বেড়াচ্ছি, আপনার ঘুমের ব্যাঘাত ঘটিয়ে জাগাতে চাইনি, কিন্তু আর যে পারলাম না! জুয়েল ভাই খুব আগ্রহের সাথেই বললেন, আরে বলেন কি? আপনি আমাকে ফোন করবেন না? আমি তো বলেই দিয়েছিলাম। কাউকে পাঠাতে হবে? বললাম, তা লাগবে না আপনি শুধু -এড্রেস টা বলে দিন। ৫১ নং বাসা খুঁজে পেতে একটু দেরী হলো। ৩ কি ৪ তলা বাড়ীর দোতলার একটা প্লট। সাহস করে সিড়ি ভেঙ্গে দোতলায় উঠেই দেখি দরজায় বাংলা ষ্টিকার লাগানো ‘আসসালামু আলাইকুম’।
জুয়েল ভাইয়ের সাথে কিছু গল্প গুজব করে আমি রাতের ঘুমের কাজা দিতে বিছানায় গা এলিয়ে দিলাম। ইতিমধ্যে হাবিব ভাই এসে পৌঁছলেন। বেলা সাড়ে ১১ টায় আমার প্রথম পদযাত্রা শুরু হয়। প্রথমেই গন্তব্যস্থল ঠিক করি সিঙ্গাপুর ইসলামিক সেন্টারে। আমার কাছে যে ফোন নম্বর ছিল সে নম্বরে ফোন করলে তারা আমন্ত্রণ জানায়। বাসা থেকে বেরিয়ে প্রথমেই চলে যাই মাটির নিচের রেলগাড়িতে। এ রেলগাড়ী কোথাও সম্পূর্ন মাটির তলে, কোথাও বা মাথার উপরে আকাশপথে। বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকাসহ পদ্মা, যমুনার পূর্বাংশে প্রচলিত মিটার গেজের মতই এ রেলগাড়ী। সংক্ষেপে বলা হয়(এম, আর, টি বা মাস রাপিড ট্রানজিট) পুরো সিঙ্গাপুর শহরের আনাচে কানাচে ঘুরেছে এ রেলগাড়ী বা রেল লাইন। মূল শহরের লাইন সম্পূর্ণ মাটির নীচে। মূল শহর থেকে বেরিয়ে উপশহরে এসে এ লাইন ক্রমশঃ মাথার উপরে উঠে গেছে। অনেক উপরে, ধরা-ছোঁয়ার বাইরে। নীচে সড়ক পথ, গাড়ী ঘোড়া। এ রেল লাইনে পুরো সিঙ্গাপুরে মোট ৪২ টি স্টেশন রয়েছে। তন্মধ্যে ১৫ টি মাটির নীচে। বাকীগুলো মাথার উপরে। নীচে মানে অনেক নীচে গভীর তলদেশে।
আমার স্মরণ আছে মাটির নীচের স্টেশনে যাবার জন্য আমরা ৩ সিঁড়ি বদল করেছি, প্রতিটি সিঁড়িতে ২৫/৩০ টি তাক রয়েছে। সিঁড়ি মানে চলন্ত বৈদ্যুতিক সিঁড়ি। তার মানে ৮০/৯০ আ ১০০ টি তাক নীচে এসব স্টেশন। মজার ব্যাপার হলো ২/৩ টি জংশন স্টেশনও রয়েছে সে সব স্থানে, রেল লাইন বা স্টেশনগুলি উপর-নীচে। তার মানে আরো নীচে গিয়ে অন্য লাইন ধরতে হবে। এসব লাইনে গাড়ী নিমিষে আসে নিমিষেই চলে যায়। গাড়ীর গতি জানার সুযোগ হয়নি, তবে গতিবেগ ১০০ কিলোমিটারের কম হবে বলে মনে হয় না। মাটির নীচে বাতাসের প্রতিকূলতা কম। এসব গাড়ী 2 থেকে 3 মিনিট পর পর আসে। প্রতি স্টেশনে ৮/১০/ সেকেন্ড থাকে, মুহুর্তেই আবার উড়াল দেয়। এক স্টেশন থেকে অন্য স্টেশনে যেতে ১ থেকে দেড় মিনিট লাগে। আমি ঘড়ি দেখে দেশ কয়েকবার পরীক্ষা করেছি কোন বারই ১ মিনিট/৪৫ সেকেন্ডের বেশী লাগেনি। পুরো, ষ্টেশন পুরো গাড়ী শীতাতাপ নিয়ন্ত্রিত এবং কম্পিউটার নিয়ন্ত্রিত। গাড়ির সবগুলো দরজা একই সময় খুলবে এবং বন্ধ হবে। মনে করুন গাড়ির দরজা বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল এমন সময় আপনি ঢুকতে যাচ্ছিলেন, ড্রাইভার দেখে ফেলবে, দরজা খুলে যাবে এবং আপনাকে সাবধান করে দেয়া হবে। শুধু গাড়ির দরজা নয় মাটির নীচের ষ্টেশনগুলিতে ষ্টেশনেরও দরজা আছে রেল লাইনের দিকে।
ট্রেন এসে দাঁড়াবে ঠিক গাড়ির এবং ষ্টেশনের দরজা বরাবর হয়ে। একই সমান্তরালে খুলে যাবে দু’টো দরজাই। গাড়ির ভেতরে বসার সিটের পর দাঁড়ানোর ব্যবস্থাও আছে। দাঁড়াতেও বেশি কষ্ট নেই। এত দ্রুত চললেও ঝাঁকুনি নেই বললেই চলে, শুধু ছাড়া এবং থামানোর সময় মৃদু ঝাঁকুনি লাগে। ষ্টেশনের আওতায় পৌঁছার পর থেকে ষ্টেশনে বা গাড়িতে কোথাও ধূমপান বা পানাহার করা নিষিদ্ধ। করলে ৫০০ ডলার জরিমানা দিতে হবে। স্টেশনে এবং গাড়িতে এখানে- সেখানে স্টিকার লাগানো আছে এ নিষেধাজ্ঞা দিয়ে। গাড়ির ভেতরে অন্য একটি স্টিকার দেখলাম যাতে লেখা আছে এই সিটগুলো বয়স্ক, কিংবা গর্ভবতী মা দের জন্য, সাথে কিছ’ ছবি আঁকা আছে এক বুড়ো, ব্যাগওয়ালা মহিলা এবং বাচ্চা ওয়ালা মহিলা দেখলে সীট ছেড়ে দেয়া।
গাড়ি এক মাথা থেকে অন্য মাথা বরাবর দেখা যায়। গাড়ি চলার সময় যখন বাঁকা লাইন পড়ে তখন গাড়ি এমনভাবে ঘুরে যে এক মাথা থেকে অন্য মাথাকে চমৎকারভাবে ঘুরে যেতে দেখা যায়। পানিতে মাছ যেমন মোড় নেয়ার সময় সুন্দর করে লেজ ঘুরায়, গাড়ির সামনের মাথায় দাঁড়ালে বাঁক নেয়ার সময় পেছনের অংশকে সে রকম লেজই মনে হয়। গাড়ির টিকেট বা চেকিং সিস্টেমও ভারী মজার। পুরো এলাকার কোথাও কোন গার্ড বা পুলিশ নেই। কম্পিউটার গার্ড দিচ্ছে। কোথেকে এলেন, কোথায় নামলেন- কম্পিউটারে সব রেকর্ড করা আছে। আমরা প্রথমেই যে ষ্টেশনে ঢুকলাম। সেখানে আমার সঙ্গী দু’জনের টিকেট কার্ড আগেই ছিল, যা অনেকটা ক্রেডিট কার্ডের মত। আমার দু’সঙ্গী আমাকে নিয়ে একটা কাউন্টারে গেলেন, একটা পুরনো কার্ড এবং ১০ ডলারের একটা নোট এগিয়ে দিলেন, কাউন্টারের কর্তব্যরত মহিলা কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই সেই পুরনো কার্ডটা ফেরত দিলেন, প্রদত্ত এ ১০ ডলার নাকি এই কার্ডে প্রবিষ্ট করালাম এবং সাথে সাথে গেট খুলে গেল আর অন্য স্থানে ঐ কার্ডটা বেরিয়ে গেল। ব্যাস। ষ্টেশনে ঢুকে ট্রেনে করে আপনার গন্তব্য স্টেশনে চলে গেলেন, সে ষ্টেশন থেকে বেরুনোর সময় আবার কার্ড প্রবিষ্ট করিয়ে গেট খুলে বেরুতে হবে, ব্যাস। এতেই কম্পিউটার বুঝে যাবে আপনি কোথেকে এসেছেন। সে ষ্টেশন থেকে এ ষ্টেশনের ভাড়া কত এবং ভাড়া কেটে রেখে দেবে কম্পিউটার নিজেই।
মজার ব্যাপার হলো আপনার কার্ডের কোথায় ভাড়াটা লুকিয়ে আছে আপনি তো দেখছেন না। এখন মনে করুন আপনার কার্ডের ভেতর আর মাত্র ৫০ পয়সা আছে, অথচ আপনি যে ষ্টেশন থেকে এখানে এসেছেন তার ভাড়া ৬০/৭০ পয়সা বা তারও বেশি, তখন আপনি বেরুনের সময় কার্ড ঢুকালেও কিন্তু গেট খুলবেনা বরং আপনার কার্ডটাই আটকে যাবে।
আবার মনে করুন আপনার কাছে কার্ড নেই তখন ইচ্ছে করলে ষ্টেশন থেকে আপনি কার্ড কিনতে পারবেন। সে ক্ষেত্রে আপনাকে চার্ট দেখে নিতে হবে আপনার ভাড়া কত। তারপর ষ্টেশনে রক্ষিত বক্সে নির্দিষ্টসংখ্যতক মুদ্রা ফেলে সুইচ টিপ দিলে অটোমেটিকভাবে আপনার জন্য সেই মুল্যমানের কার্ড চলে আসবে। ১০ ডলারের কার্ড আর ৫০ সেন্ট এর কার্ড দেখতে অবিকল একই রকম। ভেতরের মাহাত্ম্য টা আপনি না বুঝলেও কম্পিউটার বুঝে।
সিঙ্গাপুর এম, আর, টি এর সাথে আমেরিকার ওয়াশিংটন ডি, সি মেট্রো এর মিল রয়েছে। যদিও নিউ ইয়র্ক বা ফিলাডেলফিয়া অনেক শহরেই পাতাল ট্রেন রয়েছে, তবে সিঙ্গাপুর এম, আর, টি এর সাথে পার্থক্য হল এটা অনেক পরিচ্ছন্ন। তবে নিউ ইয়র্ক সাবওয়ে এর তুলনায় অনেক অনেক ছোট। তাছাড়া সিঙ্গাপুর এম, আর টি স্টেশন সহ পড়ও গাড়ি শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত। আমেরিকার যে কোন শহরেই পাতাল ট্রেন কোথাও পুর স্টেশন ঢাকা বয়া শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত নয়। সিঙ্গাপুরে এম আর টি এর সবগুলো স্টেশনই শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত। এবং স্টেশনেরও দরজা আছে যেটা ট্রেনের দরজার সাথে খোলে।
এখানে বাস সিস্টেমটাও খুব সুন্দর। কোন কন্ডাকটার নেই। চিল্লাচিল্লি ডাকাডাকি নেই। সময় হলে বাস ভর্তি হয়ে যাব কিংবা একেবারে খালী থাকুক বাস ছেড়ে যাবে। ভাড়া নেয়ার জন্যও কেউ আসবে না। আপনি বাসে উঠেই যেখানে যাবেন সে ষ্টেশনে ভাড়া একটি বক্সে ফেলবেন টিকেটটা নিয়ে গিয়ে সীটে বসবেন। আর আপনার কাছে যদি কার্ড থেকে থাকে সে কার্ড আপনি বাসেও ব্যবহার করতে পারেন। কার্ডের আলাদা বাক্সে কার্ড প্রবিষ্ট করিয়ে সমপরিমান ভাড়ার সুইচ টিপলে আপনার টিকেট এবং ভাড়া কেটে আপনার কার্ড ফেরত আসবে।
সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো মনে করুন আপনি ট্রেনে চড়েছেন সে ক্ষেত্রে বাসের কম্পিউটার কিন্তু ঠিকই টের পেয়ে যাবে যে আপনি এইমাত্র ট্রেন ভ্রমন করে এসেছেন। আর সে ক্ষেত্রে আপনার কাছ থেকে অর্ধেক ভাড়া কাটবে এবং আপনার টিকেটে লেখা হয়ে যাবে, ভাড়া কত ছিল আর কত রাখা হয়েছে।
বেলা ১১ টার দিকে আমরা সিঙ্গাপুর ইসলামিক সেন্টারে পৌঁছলাম। তখন জোহরের নামাজের সময়। সেন্টারে ‘মসজিদ মুহাজিরীন’-এ আমরা জোহরের নামাজ আদায় করলাম। বেশ বড় মসজিদ। নিচ তলায় মসজিদের বিভিন্ন সংস্থার অফিস, মহিলা এবং বয়স্ক শিক্ষা কেন্দ্র। দোতলায় নামাজ ঘর। প্রতিটি কাতারে ৪০/৪৫ জন মুসল্লী নামাজ আদায় করতে পারবে। আমরা দ্বিতীয় কাতারের মাঝামাঝি দাঁড়ালাম অর্থাৎ জোহরের নামাজের সময় ৫০/৫৫ জন মুসল্লী ছিল।
নামাজ শেষে ইসলামিক সেন্টারের অফিসে গেলে নতুন মুখ দেখেই ২/৪ জন এগিয়ে এলেন, খোঁজ খবর নিলেন। জৈনুদ্দিন নামে জনৈক দাড়িওলা ভদ্রলোক আমাদের সাদর সম্ভাষণ জানিয়ে বললেন, তোমরা বড্ড দেরী করে ফেলেছো। আজ শনিবার দুপুর ১ টায় ছুটি, তবু তোমরা যেহেতু আগে থেকে ফোন করে এসেছ, দেখা যাক কি করা যায়। তিনি কিছুক্ষন পর ফিরে এসে আমাদেরকে জাফর সাহেব কাশিম নামে জনৈক অফিসারের কাছে নিয়ে গেলেন। জাফর সাহেব প্রথমে আমাদের পরিচয় নিয়ে নিজের পরিচয় দিয়ে তাদের কার্যক্রম সম্পর্কে ছোট খাট একটা বর্ণনা দিলেন। সাথে সাথে তাদের বেশ কিছু প্রচারপত্র তাদের প্রকাশিত একটি ম্যাগাজিন ২ টি সংখ্যা সহ কিছু কাগজ পত্র দিলেন, যাতে অমুসলিমদের উদ্দেশ্যে ইসলামের প্রাথমিক পরিচিতিমুলক বুলেটিনও ছিল। আলাপের এক পর্যায়ে আমি বললাম, দেখ আমি বিশেষত সিঙ্গাপুরের মুলমানদের সম্পর্কে জানতে চাই। এই সম্পর্কে আমি এই বই লিখব। ভদ্রলোক মনে হলো এতক্ষন কথা বলে আমার উপর আস্থা আনতে পারলেন। তারপর ভেতরে গিয়ে অত্যন্ত মূল্যবান একটা বই নিয়ে এলেন, যে বইটি সিঙ্গাপুরী মূল্যে ৫০ বা 60 ডলারের কম হবে না। ১৭/১৮ ইঞ্চি লম্বা, ১২/১২ ইঞ্চি প্রস্থ, এই বইটি সম্পূর্ন মোটা আর্ট পেপারে চার রংয়ে ছাপানো। বইটির একপাশে সিঙ্গাপুরের মুসলমানদের সম্পর্কে বর্ণনা থাকলেও বইটিকে মূলতঃ একটি ফটো অ্যালবাম বলা যেতে পারে। মুসলমানদের বিভিন্ন কার্যক্রম এবং মসজিদের রঙ্গিন ছবিতে বইটি ভরা।
সিঙ্গাপুর ছোট্ট একটি দ্বীপ। ৬০০ বর্গ কিলোমিটার আয়তনেরও কম। ১৯৬৫ সালের আগে এটি মূলতঃ মালয়েশিয়ার একটি প্রদেশ ছিল। আয়তনে ক্ষুদ্র হলেও দেশটি বিশ্বের মাঝে বেশ পরিচিত। বিষুব রেখার মাত্র ১৪০ কিলোমিটার উত্তরে অবস্থিত এ দ্বীপটিতে প্রাকৃতিক সম্পদও তেমন কিছুই নেই। প্রধান আয় মূলতঃ পর্যটন এবং ব্যবসা। ১৮১৯ সালে এ প্রদেশের জনসংখ্যা ছিল মাত্র ১ হাজারের মত। আর বর্তমানে প্রায় ৩০ লাখ। ১৯৮৩ সালের আদমশুমারী অনুসারে ২৪ লাখ মুসলিম। এদের ৯০%ই মালয়েশিয়া, ভারতীয় বা আরব বংশোদ্ভূত. যারা ব্যবসা করতে এসে ইসলাম প্রচার করেছিল।
সিঙ্গাপুরের নাম শুনলেই আমরা চমকে উঠি। আমেরিকা, ইউরোপকে আমরা যত মনে করি, সিঙ্গাপুরকে মনে হয় কেউ কেউ তার চে বেশী মনে করি। দেশে থাকতে এক বন্ধুর কাছে গল্প শুনেছিলাম যে, সিঙ্গাপুরে নাকি প্রতিটি বাড়িতে ঢোকার আগে দরজার বাইরে বারবণিতার জুতা পাওয়া যায়। অর্থাৎ ভেতরে একজন আছে। বারবণিতারা নাকি ঘরে ঘরে গিয়ে খদ্দের খোঁজে। কথাটা নিঃসন্দেহে অতি রঞ্জিত, আমার কাছে এমন কিছুই মনে হয়নি। সিঙ্গাপুরের অধিবাসী কিংবা প্রবাসী প্রায় প্রতিটি মুসলমানের। সিঙ্গাপুরে প্রবাসী বেশ কিছু বাংলাদেশী মুসলমানদের সাথে আমি কথা বলেছি, যারা নিয়মিত নামাজ পড়েন। প্রত্যেকের প্রায় একই মন্তব্য, সিঙ্গাপুর এমন একটি দেশ যেখানে ভাল থাকার বেশ সুযোগ আছে, আর খারাপ হবার ইচ্ছা করলে সিঙ্গাপুরের অজস্র মাধ্যম খারাপ হবার পথে সহজভাবেই নিয়ে যাবে।
৬০০ বর্গ কিলোমিটারের কম আয়তনের ৩/৪ লক্ষ মুসলমানদের এই দেশে ৮৪ টি মসজিদ আছে (তথ্যকাল সময় ১৯৯৪ সাল) এবং কোনো মসজিদই নামের মসজিদ নয়, প্রতিটি মসজিদই আজান হয়, পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ হয় এবং আরো নতুন মসজিদ তৈরী হচ্ছে। সিঙ্গাপুরে প্রতি ১৮ ঘন্টায় একজন করে অমুসলিম ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হচ্ছে। সম্ভবতঃ সিঙ্গাপুরেই অমুসলিমের ইসলাম গ্রহণের হার বেশী। আর সিঙ্গাপুরের মসজিদগুলিও ইসলামের সামাজিক-সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ঠ্য বজায় রাখছে। এখানে লক্ষণীয় একটা ব্যাপার হলো, সিঙ্গাপুরের জনসংখ্যার ৭৭% চাইনীজ। আর স্বভাবগতভাবে চীনারা চরম বস্তুবাদী। তারা টাকা-পয়সা আর মুনাফা ছাড়া পৃথিবীর আর কিছুই বুঝে না। কিন্তু তারা নাস্তিকও নয়, ধর্মবিরোধীও নয়। তাই মুসলামানদের ব্যাপারে তাদের মাথা ব্যাথাও নেই। সরকারের (স্বভাবতই চীনা) কথা হলো, তুমি যে ধর্মই পালন কর, দেশের উন্নতি কর, কাজ কর। অযথা বিতর্ক সৃষ্টি করে কাজের ক্ষতি করবে, সরকার সেটা চায় না। অপরদিকে চরম বস্তুবাদীতার কারণে মানুষ শান্তির খোঁজে বেরিয়ে এসে ইসলামের ছায়াতলে এসে দাঁড়ায়। তবে এ কথার অর্থ এটা কিছুতেই নয় যে, সিঙ্গাপুর সম্পর্কে যা রটেছে সবই মিথ্যা। না, তা নয়। খারাপ হবার সকল উপায়-উপকরণই এদেশে আছে। আপনার হাতের কাছে বিশাল অট্রালিকার পতিতালয় আছে। যে কোন নারী পার্ট টাইম বা ফুল টাইম দেহ ব্যবসা করতে পারে। এমনও শোনা গেছে কোনো কোনো স্ত্রী স্বামীর অফিস টাইমে পতিতালয়ে পার্ট টাইম দেহ ব্যবসা করে। কোন বাধা নেই।
সিঙ্গাপুর একটি ছোট্ট দ্বীপ, অর্থাৎ চার পাশ্বেই সমুদ্র সৈকত। সূর্য যখন অস্ত যায়, ঠিক আলো-আঁধারী গৌধুলীলগ্নেই সৈকতের আবছা আলোতে দেখতে পাবেন বিবস্ত্র যুবক-যুবতীর ঝাপটাঝাপটি। অজস্র মানুষ হেঁটে যাচ্ছে, রুচিবোধসম্পন্ন মানুষরা চোখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। কিন্তু লাভ নেই। সামনেই আবার দেখতে পাবেন অন্য যুগল, হয়তো বা আপনার চলার পথের পাশেই। অনেক সময় কৌতুহলী অবুঝ কিশোররা তাকিয়ে তাকিয়ে নোংরা মজা লুটে। কিন্তু ক্রিয়ারত যুবক-যুবতীর তাতে সামান্যতম ভাবান্তরও হয়না।
বিকেলে গিয়েছিলাম সেরাংগুন রোডে। সিঙ্গাপুরে প্রবাসী বাংলাদেশীরা এটাকে বাংলাবাজার বলে। অসংখ্য বাংলাদেশী এখানে। বৈধ-অবৈধ সব। এই মার্কেটে হাঁটতে চলতে আপনি বাংলা কথাও শুনবেন। বাজারের পাশ্বেই মসজিদ। মাসজিদ এংগলিয়া। এ মসজিদে বাংলা অনুবাদ মিশকাত শরীফ আছে। সামান্য দূরেই একটা হোটেল আছে, হোটেল মানে রেস্টুরেন্ট। নাম হোটেল সোনারগাঁও। মালিক বাংলাদেশী। বেয়ারা-কর্মচারী, বাংলাদেশী- অবাংলাদেশী সবই আছে। রেস্টুরেন্টের ভেতরে বেশ সুন্দর পরিপাটি করে সাজানো। দেয়ালে বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ ভবন, জাতীয় স্মৃতিসৌধ, বায়তুল মোকাররম মসজিদ, ষাটগম্বুজ মসজিদের বড় ছবি আয়নার ফ্রেমে বাঁধানো আছে। প্রচুর বিদেশী বাংলাদেশী খাবারের স্বাদ আস্বাদনের জন্য এ হোটেলে এসে থাকে। দাম মালয়েশিয়ার তুলনায় একটু বেশী হলেও বাংলাদেশী খাবারের যথাযথ স্বাদ পাওয়া যায়। দাম বেশী মানে বেশ আমরা ৪ জন খেলাম একটু করো করে মাছ আর সবজি দিয়ে, বিল আসলো ২৮ ডলার। মালয়েশিয়াতে এটা হতে পারে বড় জড় ১০ ডলার (মালয়েশিয়ান রিঙ্গিত)
পরদিনের পরিকল্পনা ছিল সিঙ্গাপুরের সবচে আকর্ষণ সান্তোসা দ্বীপ। আমার সাথে ছিলেন ঢাকায় থাকাকালীন আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু হাবিব ভাই এবং নিয়াজ ভাই। বস্তুতপক্ষে যাঁরা ছিলেন সিঙ্গাপুরে আমার একমাত্র সঙ্গী।
বাসা থেকে বেরুতেই প্রায় ১১ টা বেজে গেল। হাবিব ভাইরা থাকেন অনেক দূরে, সেখান থেকে এলেন তারপর বেরুলাম। মূল শহর থেকে টেকসী নিলাম ভাড়া আসলো ৭ ডলার। নদীর এপার থেকে ওপাড়ে যেতে হবে ফেরীতে, দুরত্ব অর্ধ বা সিকি মাইল হবে বোধ হয়, অথচ ভাড়া সাড়ে ৬ ডলার।
সান্তোশা গিয়ে ফেরী থেকে নেমে ইতস্ততঃ অপরিকল্পিত ঘুরছিলাম, ২/৪ টা ছবি তুললাম। মনে হলো আমরা হয়তবা ভুল পথে এসেছি, কারণ এত ব্যস্ত এত পরিচিত দ্বীপে আমরা যে পথে যাচ্ছি সে পথে তেমন জন সমাগম দেখিনি। এক সময় এক বুড়ো চাচাকে অতিক্রম করছিলাম। দেখতে বাংলাদেশই মনে হল, চাচার বয়স পঞ্চাশের কাছাকাছি। পাকা-কাঁচা মিলিয়ে দাড়ি চুল। গায়ে বাংলাদেশী স্টাইলের পাঞ্চাবী। চাচা বার বার আমাদের দিকে তাকালেন, তাই আলাপচারিতার বাংলাতেই শুরু করলাম। আরে বাবা, চাচার বাড়ি বাংলাদেশ তো বাংলাদেশ এক্কেবারে নোয়াখালী, নোয়াখালীর বেগমগঞ্জ। এই চাচাই আমাদেরকে দিক নির্দেশনা দিলেন যে আমরা ভুল পথে এসেছি। চাচা ৫ বছর যাবৎ সিঙ্গাপুর কাজ করেন। আমাদের চাচাত ভাই অর্থাৎ চাচার ছেলে এবং ভাতিজা কাজ করেন এই সান্তোসা দ্বীপেই। তাই সেনতোসা’র সবকিছু চাচার নখদর্পণে। এই দ্বীপটি মাত্র কয়েক বর্গ একরের হবে। দ্বীপের মধ্যে হাঁটার দরকার বা ব্যবস্থা নেই। পুরো দ্বীপটি পরিকল্পিত খেলাঘর। এখানে রয়েছে জাদুঘর, রয়েছে টআন্ডার ওয়াটার ওয়াল্ড বা পানির নিচের জগৎ। যাকে বলে চীনা বৃদ্ধি। পানি বা নদীর তলায় সুন্দর কাঁচের ঘর তৈরী করা হয়েছে স্থলভূমি থেকে সেখানে যাবারও সুন্দর ব্যবস্থা আছে। ভারি সুন্দর ঘর। কাঁচের ঘরেই বাইরেই নানা প্রকার জলজন্তু। বিভিন্ন আয়তন ও রঙ্গেরর মাছ ছাড়া ঝিনুক-শামুকসহ বিভিন্ন সামুদ্রিক জীব। পুরো দ্বীপটি ঘুরে ঘুরে দেখার জন্য রয়েছে বিনামূল্যে বাস এবং ট্রেন সার্ভিস। ট্রেন নয়, আসলে খেলনা বলা যেতে পারে, দৈর্ঘ্য বা প্রস্থে। বিভিন্ন শিশু পার্কে শিশুদের জন্য খেলনা গাড়ি যে ধরণের, এটাও সে ধরণের। তবে মজার ব্যাপার হলো এটা চলে একটি মাত্র মোটা লাইন দিয়ে শূন্যের উপর দিয়ে।
বিকেল ৪ টায় সেনতোসা থেকে ফিরে এলাম। বাকী সময়টা কাটলো হাবিব ভাই, নিয়াজ ভাইদের বাসায়। নিয়াজ ভাই এক পলক ঘুমিয়ে নিলেন, আমি পারলাম না। মাথায় রাজ্যের চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে। মাগরিবের পূর্বক্ষণে পায়েস আনলেন নিয়াজ ভাই। চমৎকার রান্না, যাকে বলে অমৃত স্বাদ। রাতে আবার সেই বাংলা বাজার বা সেরাংগুন রোড। রাতের খাবারের জন্য বের করা হলো একটা মসলিম হোটেল। রান্না অবিকল মালয়েশীয় স্টাইল। খাওয়া পর্বের শেষ পর্যায়ে আমি গলায় একটু গাম্ভীর্য এনে হাবিব ভাইকে বললাম, আপনি কি চান আগামীকালও আমাকে সঙ্গ দেন? হাবিব ভাই কিছুটা চমকে উঠলেন, ভাবলেন হয়ত বা কিছু একটা বিষয়ে আমি মাইন্ড করেছি। তিনি কিছুটা শুকনো গলায় উত্তর দিলেন, হ্যাঁ চাই, কিন্তু কি হয়েছে? আমি বললাম তাহলে আজকের রাতের খাবার বিল আমি পরিশোধ করবো। হাবিব ভাই সাথে সাথেই শুকনো মুখে সতেজ ভাব ফিরিয়ে এনে বললেন, ওই সে জন্য, তাহলে না আমরা চাইনা যে আগামীকালও আপনি আমাদের সাথে থাকেন। যাক. শেষ পর্যন্ত তারা আমাকে বিল দিতে দিলেন না।
পরদিন সকালেই আমার চলে আসার কথা, কিন্তু বেশ কিছু জরুরী কাজ খেকে গেল, শহরের বড় বড় ভবন নিয়ে ছবি তোলা ইত্যাদি। তাই যাত্রা বিলম্ব হলো। প্রচন্ড তাপদাহেও নিয়াজ ভাই সময় দিলেন। শহরে ঘুরে ঘুরে ছবি তুললাম। হাঁটার অভ্যস্ততা ছাড়াও নিয়মিত ব্যায়াম করার কারণে হাঁটতে আমার কষ্ট হলোনা, সমস্যা হচ্ছিল নিয়াজ ভাইকে নিয়ে, কিন্তু বেচারা ভদ্রতার খাতিরে কিছু বলতেও পারছিলেন না, আর কোনো রিকসাও নেই যে উঠব। এভাবে হাঁটতে গিয়ে এখানে ট্যাক্সি কেউ নেয়না, ট্যাক্সি নিলে দেখাও যায়না, তাছাড়া ব্যয়বহুলও।
দুপুরে খাবারের জন্য জুয়েল ভাই দাওয়াত করলেন, সেরাংগুন রোড এলাকায় সেই সোনারগাঁও হোটেলে, বাংলাদেশী খাবারের দোকান। বিদায়ের আগে জুয়েল ভাইয়ের বাসায় গেলাম, স্মৃতি ধরে রাখার জন্য রাস্তায় ৪ জনে মিলে ছবি তুললাম। ‘শখের পিঠা কাঁচা হয়’ তাই ছবিটা নষ্ট হয়ে গেল। আমাকে এগিয়ে দেয়ার জন্য হাবিব ভাই, নিয়াজ ভাই বাস স্ট্যান্ড পর্যন্ত এগিয়ে এলেন। হাবিব ভাই, জুয়েল ভাইকে বিদায় দেয়ার কিছুক্ষণ পরই বাস ছাড়ে। সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়া সীমান্ত পেরিয়ে জোহরবারু রাজ্যে আসার পর আমাকে বাস বদল করতে হয়েছে।
জোহর বারু এসে বাসে বসতে গেলাম, মিনিটখানেকের মধ্যে বাসের পেছনে দিক থেকে এক যুবক এগিয়ে এলো, গায়ের রং তামাটে-কৃষ্ণ মিশ্র। লম্বা নাক, টানা চোখ। বোঝা যাচ্ছিল, উপমহাদেশীয়। যুবকটি প্রথমেই ইংরেজীতে বলল, “হয়ার আর ইয়উ ফর্ম?” কোন নতুন লোককে প্রথমেই কিছু জিজ্ঞেস করার আগে ভদ্রতা প্রকাশ করা অন্ততঃ “এক্সকিউজ মি” বলার নিয়ম, সরাসরি এভাবে প্রশ্ন করা বেমানান, তাই একটু বিরক্ত হলাম, তবু নিজকে স্বাভাবিক রেখে স্বাভাবিক গলায় বললাম, ‘বাংলাদেশ’। সাথে সাথে যুবকটি বাংলায় কথা বলতে শুরু করলো। তার বাড়ি মানিকগঞ্জ। সে সিঙ্গাপুরে থাকে। বলল লেখাপড়া করে। কিন্তু তার কথাবার্তা শুনে এবং চেহারা দেখে আমার বিশ্বাস হতে কষ্ট হচ্ছিল যে, যে সিঙ্গাপুরে লেখাপড়া করে। পরে যখন জানলাম তার ভাই, চাচা কেউ কেউ আদম বেপারী তখন তাকে মোটেই ভাল লাগছিল না। তবুও ছেলেটি আমার সহযোগিতা কামনা করছিল, সে কোনদিন মালয়েশিয়া আসেনি, তার চাচার (আদম বেপারী) বাসার ঠিকানা আছে, সে চিনে না। তার প্রতি আমার মোটেও আগ্রহ না থাকলেও তার অসহায়ত্বের ভাব আমাকে দুর্বল করছিল কিন্তু তার চাচার বাসার ঠিকানা যা লেখা দেখলাম তাও আমি চিনি না। তাই তাকে বললাম যে, এ ঠিকানা আমি চিনি না, তবুও কুয়ালালামপুর গেলে আমি চেষ্টা করব। আমার অনাগ্রহ এবং অসহযোগিতা করার অভিপ্রায় আমার ছিল এবং কোনো ফ্যাসাদে না পড়ি, সে সতর্কতাও ছিল।
ছেলেটি আমার অনাগ্রহ টের পেয়ে কিছুটা করুণ সুর দিয়ে বলল, ভাইয়া আমি আপনার দেশী, আপনি আমাকে এ সহযোগিতাটুকু করবেন না? সিঙ্গাপুরে আমরা কোনো বাংলাদেশী পেলে যথাসম্ভব সহযোগীতা করি। এ বলে সে একটা উদাহরণও পেশ করলো যে একদিন এক বয়স্ক বাঙ্গালির পেছনে সে প্রায় ১ ঘন্টা এবং ২০ ডলার টেকসী ভাড়া ব্যয় করেছে। ছেলেটির এ উদাহরণ বা কথা আমার ব্যক্তিত্বে আঘাত হানলো, একটু বিরক্তও হলাম। তবুও কিছুটা জবাবদিহি, কিছুটা কড়া স্বর মিশিয়ে বললাম আপনি কি বলছেন? একজন মানুষ হিসেবেই একজন বিপদগ্রস্থ যথাসম্ভব সহযোগিতা করা আমার দায়িত্ব। এতটুকু মানবতাবোধ আমাদের আছে। তাছাড়া আপনি আমার বাংলাদেশী ভাই। আমি তো বললাম যে কুয়ালালামপুর গেলে যথাসম্ভব দেখব। আমি ঠিকানা না চিনলে কি বলব যে, আমি চিনি। আমরা ছাত্র, এত ঘুরাঘুরি করে জায়গা চেনার সময় আমাদের হয় না। যাক ছেলেটা কিছুটা দমে গেল।
বাসে, ট্রেনে বা বন্ধু-বান্ধবদের সাথে আড্ডা দিয়ে হৈ হল্লোড় করার অভ্যাস আমার থাকলেও আমার পাশে বসে-পড়া নিজ দেশী এই যুবকের সাথে আমার একান্ত প্রয়োজনীয় ২/৪ টি বাক্য বিনিময় ছাড়া আর কোন কথা হয়নি। কারণ প্রথমতঃ আমি কেন যেন আদম বেপারী শুনলেই বিরক্ত হই, তাছাড়া ছেলেটা ছাত্র পরিচয় দিলেও তার আচরণ কেমন যেন মনে হলো।
রাত ১২ টার দিকে রাস্তায় এক স্থানে বাস থামানো হলো; চা-নাস্তার বিরতি। ছেলেটি প্রস্তাব করলো বাইরে থেকে ঘুরে আসবে ২/৩ বার প্রত্যাখ্যান করলেও যেতে হলো আমাকে। কোন ব্যক্তিকে পুরোপুরি পছন্দ না হলে তার সাথে সকল কথায় যেমন, মেতে ওঠা যায় না, তেমনি সরাসরি দ্বিমতও করা কঠিন তাহলে সেটা রাগের পর্যায়ে চলে যায়। ছেলেটি বার কয়েক অনুরোধ করার পরও না যাওয়া মানে তাকে প্রত্যাখ্যান করা, আমি চাইনি ছেলেটা মনে করুক আমি তাঁকে প্রত্যাখ্যান করছি। তাই মন না চাইলে গেলাম। ড্রিংকস নিলাম, আমি চেষ্টা করলাম মূল্য পরিশোধ করতে। মানুষ বন্ধু-বান্ধবের রাগ ভাংগানোর জন্য যেমন আচরণ করে, মনে হলো ছেলেটা বুদ্ধিমত্তার সাথে সেভাবে আমাকে আয়ত্ত করার চেষ্টা করছে। আমি মনে মনে মিটি মিটি হাসলাম। ছেলেটাকে কিছু ভাল লাগতে শুরু করার কারণ হলো সে যখন দেখছিল আমি তার সাথে বেশী কথা বলতে আগ্রহী নই, তখন সে আর আমাকে বিরক্ত করলো না। একজন মানুষ যখন অন্য একজন মানুষের দিকে আগ্রহ নিয়ে এগিয়ে যায় তখন দ্বিতীয় পক্ষ যদি পিছুটান দেয়, এতে প্রথম পক্ষ যদি অনাগ্রহ পিছু টান দেয় তাতে ওই পক্ষের আগ্রহ বাড়ে। আমার এক্ষেত্রে কিছুটা তা হয়েছিল। ছেলেটার নিষ্ক্রিয়তায় টার প্রতি আমার আগ্রহ একটু বাড়ে।
রাত ১ টার সময় আমরা কুয়ালালামপুর এসে নামলাম। সে আমাকে একটা টেলিফোন নম্বর দিয়ে তার চাচার বাসায় ফোন করতে অনুরোধ করে। ফোনে অপর পক্ষের সাথে বাংলায় কথাবার্তা বলতে পেরে আমি কিছুটা আশ্বস্ত হই। তারপর ছেলেটা আমাকে অনুরোধ জানায় তাকে বাসায় পৌঁছে দিতে। টেকসী ভাড়া যত টাকা আসে সে পরিশোধ করবে এবং আমাকে ফিরে আসার টেকসী ভাড়া দিয়ে দিবে।
আমি তার উপকারটুকু করতে রাজী হলাম নিতান্ত একটু পূণ্যের আশায়। পরবাস জীবনে এমন পূণ্য করার সুযোগ তো পাই না। কোন ভয় করলাম না এজন্য যে কুয়ালালামপুর শহরে নিশাচরদের পদচারণা আছে বলে কখনো শুনিনি। আর এ ছেলে আমাকে কিছু করতে পারবে বলে আমার ভয় হয়নি। আমাদের এক ঘন্টা লাগলো বাসাটা খুঁজে পেতে। একই জায়গায় বারবার ঘুরলাম। শেষে যে লোকটা বাসা থেকে বের হয়ে আমাদেরকে নিয়ে গেল তার সুন্দর একখানা হাসি দেখে আমার সকল সন্দেহ দূর হয়ে গেল। অপরাধীরা কখনো সুন্দর করে হাসতে পারে না। হাসিটা মূলত হৃদয়েরই বহিঃপ্রকাশ। সত্যি সত্যি আমি নিজকে দোষারোপ করতে লাগলাম তাদের আচরণ দেখে। এই গভীর রাতে তারা আমাকে না খাইয়ে ছাড়লো না। গরুর গোশত, ইলিশ মাছ ভাজা এবং মশুরের ডাল দিয়ে খাওয়ার কথা স্মরণ করে এখনো লালা ঝরছে। এসব আগেই রান্না করা ছিল সকালে পান্তা ভাতের সাথে খাওয়ার জন্য। বারবার থাকতেও বলল, কিন্তু আমি সেখানে থাকতে অস্বস্তি বোধ করি কিনা তাই চাপাচাপি করলো না। ঠিকানা ও টেলিফোন নম্বর দিয়ে যোগাযোগ করতে অনুরোধ করলো।




Comments